সমাধিস্থল
সমর ঘোষ
রেললাইন ধরে সোজা পূব দিকে এগিয়ে যাও
ব্রিটিশের লাল রেল ব্রিজ
কবিগুরু ঢাকা-কলকাতা ট্রেনে নিশান গতিতে গোয়ালন্দ ছুঁয়ে স্টিমারে পৌঁছে যেতেন ঢাকা।
শিশুকালে ব্রিজ থেকে দল বেঁধে ডিগবাজিতে
পাখির ডানায় লাফিয়ে পড়তাম স্রোতের জলে।
স্মৃতিময় ব্রিজটা পার হও
সেই ভেঙে যাওয়া পুরোনো গুমটি ঘর
হারিকেন হাতে গেটম্যানের সবুজ পতাকায়
কয়লার ধোঁয়ার ট্রেনটির ছাড়পত্র মিলতো।
বা'দিকে সোজা উত্তরে এগিয়ে যাও
তমাল গাছের শিউরে উঠা ভীতি
সন্ধ্যার অন্ধকারে লকলকে বেতের ডগায়
ঘিরে রাখা মূর্তিমান ভূত আতঙ্কের
সেই কল্পকাহিনী কানে বাজে ফিসফিস শব্দে।
ডান দিকে বিস্তীর্ণ ইটের ভাটা
হারিয়ে যাওয়া মধুময় দিনগুলো
সে ইটেই ধ্যানস্থ লাল বাড়ির ঠিকানা।
পূবে খেসারির নরম তুলার বিছানা
মাটির হাড়িতে সিদ্ধ সিমের উৎসব।
আরেকটু এগিয়ে যাও
পূবে তারা কামারের ভিটে
যে হারিয়ে গেছে সাতচল্লিশের জনস্রোতে
বোম্বাই আমের আকাশ স্পর্শী মহীরুহ
বেণুকুঞ্জের মন মাতানো হিমেল হাওয়া।
তারপর আর একটু এগিয়ে যাও
বা'হাতে নন্দীদের নয়নাভিরাম জলাধার
আম-জনতার বাধাহীন যথেচ্ছাচার
দেশান্তরিত জমিদারের স্মৃতিচিহ্ন!
এগোতে থাকো আর একটু
এখানেই বামে জলাশয়ের বুকে
দীঘল ধূসর শিমুল তরু
সেই কবে থেকে দাঁড়িয়ে
রক্ত মেখে লাল টকটকে হয়ে ফোটে
শিমুল তুলা ভেসে যায় দূরের বাতাসে
বন্ধুত্বের বার্তা পৌঁছে দূর থেকে দূরে।
তারপরে বা'হাতে কাচারি পুকুর
তপ্ত দুপুরে জলকেলির অভূতপূর্ব অনুভূতি
আষাঢ়ের রিমঝিম জলকাদাতে মেতে ওঠা!
ডানদিকে দেশভাগে ঠিকানাহীন উদ্বাস্তু
হরি'র মা'র বিষন্ন ভিটে
জামের রঙে মুখ রাঙিয়ে
হাডুডুতে অতীত করেছি কত বিকেল।
মটমটিয়া বনজামির বেল ডুমুরের মত্ত বায়ু
আর একটু এগিয়ে যাও
দু'জোড়া যুগলমূর্তির শিমুল বৃক্ষ
ভরা যৌবনে শোভিত রক্তাক্ত ফুল
লাল ঝুটির শালিখের নাচ ডালে ডালে
মৌমাছির সুকণ্ঠ মধুময় গুনগুন
আকাশ জুড়ে শিমুল তুলার শুভ্র ভেলা
পাল তুলে বহতা জলায় সুরেলা সারি গান।
স্মৃতির নকশিকাঁথা ঢেকে পূবদিকে ঘুরে যাও দক্ষিণে দেবদারু কাঁঠাল বাতাবিলেবু গাব গাছ
উত্তরে ঘাট বাঁধানো সে-ই পুকুরটি
সিঁড়িতে আর বেঞ্চে জোনাকির আলোয়
পার হয়েছে কত গোধূলি।
বাড়ির ঘাটটি এখন নরকঙ্কাল
অন্যটি দন্তহীন উপহাস মাত্র।
ভাতৃত্বের বন্ধনে জড়াজড়ি করে
আকাশপানে মাথা দুলানো বাঁশঝাড়
একঝাঁক সাদা বকের সাম্রাজ্য।
তারপর সারিসারি সুপারি গাছ
পাশেই দাঁড়িয়ে সে-ই লাল ইটের অট্টালিকা
আমার পৈত্রিক নিবাস, জন্মভুমি।
ইতিবৃত্তের হাজার বেদনার সাক্ষী
প্রতিদিনের না বলা কথার দুখিনী শৈলমালা
কালের বিমূর্ত শোকের বিলাপ
বেণীবন্ধ ইটের ইতিকথা
পূর্বপুরুষের থরে-থরে সাজানো অস্তিত্ব
ঘুনপোকা সারাক্ষণ কেটে চলে হাড়-মজ্জা!
সামনেই দক্ষিণ দিকে মুখ করে তাকাও কয়েকপা সামনে এগিয়ে যাও
ডানদিকের সেই কাচারি ঘর
মায়াবী চোখে হৃদয় মুখে
লক্ষ্মীপেঁচার রাজ্যসভা।
যৌবন হারিয়ে ঘরটি হেলেছে পূব মুখে
অতীত মুছে একান্তে বিদায় নেবে হুড়মুড়িয়ে
বারান্দায় শালকাঠের দুটি ঠেস বেঞ্চ
মনুষ্য প্রেমহীন ক্ষয়িষ্ণু যন্ত্রণায়!
বিস্তৃত বারবাড়ির উঠানের দিকে তাকাও
পূবের পেয়ারা গাছ, শখের ফুলবাগান
শ্মশানে শুকুনের উৎপাত
নীরব কান্নার মায়াবী ভালবাসা।
সামনে আরেকটু আগাও
আরেকটু সামনে
ডান দিকে আকাশপানে লিচু গাছ
থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা রসালো ফল
বা'দিকে বৃদ্ধ কাঁঠাল তরু।
সামনে তাকিয়ে দেখো
রেলের গা ঘেঁষে বিস্তৃর্ণ সীমারেখা
অস্তিত্বের মধ্যেই শকুনের কান্না
স্মৃতিময় চাদরে দুঃখময় ঠাকুরমার ঝুলি ।
শুধুই স্মরণে ভেসে ওঠে গভীর বেদনায়
ইতিহাসের পরতে পরতে বোবাকান্না
বাকশক্তিহীন অনুক্ত ব্রিটানিকা।
হ্যাঁ, এইতো ঠিকই এখন এসে দাঁড়িয়েছো
দেখো তোমার বাম হাতের কাছে
ঠিক তোমার বাম হাতের নিচে
ভাটি গাছের পাশেই
সাদা বেগুনি ভাঁট ফুল পরম মমতায় নুয়ে
মাটির কাছাকাছি কান পেতে শোনো
তুমি কী বেদনার চাপা কান্না শুনতে পাচ্ছো ?
আর একটি নিচু হও!
আর একটু!
এবার কী শুনতে পাও মাটির ভেতরে কান্না ?
বেদনার কান্না, অব্যাক্ত অনুভূতির কান্না
সরল সমীকরণের জটিল অনুভূতি!
মাটি ফুঁড়ে বেদনার স্মৃতি শুধুই ডুকরে কাঁদে।
এটিই আমার সমাধি!
মনোজাগতিক সমাধি!
বংশ পরম্পরায় মানসিক সমাধি।
আমাদের সমাধিস্থল।