যমুনার বুক চিতিয়ে সারি সারি খাম্বা। তারের পরে তার জুড়ে দিয়ে এ লাইনের বিদ্যুত গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। জাতীয় গ্রিডের ৩৩ হাজার কিলো ভোল্টের সঞ্চালন লাইন এটি। ইতোমধ্যে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে এলাকাবাসীর জন্যে। যে কোনো সময় ধ্বসে পড়তে পারে এসব টাওয়ারের একাধিক। কারণ এই টাওয়ারের তলদেশ থেকে ইতোমেধ্যে মাটি সরে গেছে-এমন ধারণা করা হচ্ছে। আর তাতেই মারাত্মক দুর্ঘটনার আশঙ্কায় এলাকাবাসী। গেল ক’মাস ধরে টানা বালু তোলার ফলে এমন সম্ভাবনাই দেখা দিয়েছে। এসব কথা বেশ জোড়েশোরেই বললেন কাছের গ্রাম আলোকদিয়ার হাজারো বাসিন্দা।
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার আলোকদিয়ার মানুষই শুধু নয়-আশপাশের আরও তিনটি গ্রামের মানুষও এখন উৎকণ্ঠিত। যমুনা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বাড়ি ঘর বিলীন হবার আশঙ্কায় আছেন তারা। এসব গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে হুমকির মধ্যে। শীতের শেষে বসা ভাঙনে ফসলি খেতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। এসব নিয়ে একদিন আগে গত রোববার ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে স্থানীয় আলোকদিয়া আর তেওতা গ্রামের ভূক্তভোগীরা।
সরেজমিনে যমুনার পাড়ে কথা হয় আলোকদিয়া গ্রামের মুরুব্বি জাকির হোসেনের সঙ্গে। তাঁর অভিমত, যারা বালু কাটছে এরা কোন বড় মাপের সন্ত্রাসী কিংবা পাওয়ারফুল কেউ নয়। টাকার জোড়ে তারা জেলা প্রশাসনকে হাত করেছে। আর মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক তার এলআর ফান্ড যোগার করতেই সন্ত্রাসীদের এই অবৈধ সুযোগ করে দিয়েছেন। যদিও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসক বালু কাটার ব্যাপারটি একেবারেই জানেন না। কেউ অভিযোগ আকারে জানালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আপত্তি থাকবে না।
মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের আলোকদিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. জামাল হোসেন। তিনি নেতৃত্ব দিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে মানববন্ধন করেছেন। কারণ প্রেস ক্লাবের পাশেই বিদ্যুত ভবন। সেখানে বিদ্যুত দফতরের বড় বড় কর্মকর্তারা বসেন। জাতীয় গ্রিডের ৩৩ হাজার কিলো ভোল্টের খাম্বাগুলোর গোড়া থেকে মাটি কিংবা বালু সরে পড়লে কতোটা ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে তা জানান দিতেই জামাল হোসেনের ঢাকামূখী উদ্যোগ।
ব্যাপারটি নিয়ে গত ৮ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন তেওতা আর আলোকদিয়ার মানুষ। যে অভিযোগে উঠে আসে বালু উত্তোলনকারীদের যাবতীয় পরিচয়। এমনকি আলোকদিয়ায় অসংখ্য বৈদ্যুতিক খুঁটি রয়েছে যা অচিরেই উপরে পড়তে পারে।
মানিকগন্জ জেলা প্রশাসন জানায়, সরকারিভাবে ওই এলাকায় কোনো বালু মহাল ইজারা তারা দেয়নি। কিন্তু মানিকগঞ্জ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক তাকবীর এন্টারপ্রাইজের মালিক আবুল বাসারের নেতৃত্বে একটি চক্র তার খাম্বার পাশে লোড ড্রেজার বসিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বালু উত্তোলন করছে। ফলে খাম্বাগুলো হুমকির মুখে রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিমত, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় আবাদি জমি ও চলাচলের রাস্তা যমুনা গর্ভে বিলীন হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে দুটি স্কুল, মুজিব কেল্লা ও আশ্রয়ন প্রকল্প হুমকির মধ্যে পড়েছে।
শিবালয় উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বেলাল হোসেন বলেন,আলোকদিয়ার যমুনা নদীতে অবৈধ বালু কাটার বিষয়টি জানতে গত ১৭ ডিসেম্বর একটি অভিযান চালিয়েছিলাম। কিন্তু অভিযানের খবর জানতে পেরে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা পালিয়ে যায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, চলতি ডিসেম্বরে তারা একাধিক অভিযান চালালেও তা কোন কাজে আসেনি। বরং বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত তিনটি কাটার মেশিন জব্দ করা হয় এবং অবৈধভাবে বালু কাটার দায়ে ৪ লাখ টাকা জরিমানাও হয়। তেওতা ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা বাদী হয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত মামলা করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরও জানান, যমুনার তীরবর্তী আলোকদিয়া এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা অভিযান স্থলে পৌঁছার আগেই অবৈধভাবে বালু কাটায় নিয়োজিত লোকজন পালিয়ে যায়। ফলে অপরাধীদের হাতেনাতে ধরা সম্ভব হয় না। তেওতা গ্রামের শিক্ষক সৌরভ হোসেন বলেন, প্রশাসনের সাথে বালু সন্ত্রাসীরা চোর পুলিশ খেলছে। যে কারণে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ ব্যাপারে তারা পরিবেশ উপদেষ্টার সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। তাদের ধারণা এসব খাম্বার একটি দুটি যদি যমুনা গর্ভে ধ্বসে পড়ে তাহলে যে ভোগান্তির জন্ম হবে তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং বড় ধরণের দুর্ঘটনা এড়াতে অবিলম্বে বালু তোলা বন্ধের দাবি তাদের।