হেমন্তকাল এসেছে গৌড়বাংলায়। রাতের আকাশে অজস্র তারা। সত্তর ও আশির দশকে ঢাকায় এত বহুতল ভবন ছিল না। তখন ছাদে উঠলে যে আকাশ দেখা যেত তা এখনকার চেয়ে অনেক অনেক বড়। আমাদের পুরনো বাড়ির ছাদে বা টানা বারান্দায় দাঁড়ালে দেখতে পেতাম আকাশে তারার মেলা। বাবা আমাকে নক্ষত্র চেনাতেন। কালপুরুষ, সপ্তর্ষি, অরুন্ধতী কত কত নাম। বাবার কাছে শুনতাম তার ছোটবেলার ঢাকা শহরের গল্প।
আমার বাবা মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর জন্ম ১৯২৬ সালের ৪ নভেম্বর। তার শৈশব কেটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তখন শিক্ষকদের জন্য ছিল বাংলোবাড়ি। বাবা ছোটবেলায় ছিলেন গেট হাউজে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শহীদ মিনারের কাছে অবস্থিত গেটভবনে তারা থাকতেন। পরবর্তিকালে তারা ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাছে লাল রঙের বাংলো বাড়িতে চলে আসেন। বাংলো বাড়ির চারপাশে বিশাল এলাকা। আমার দাদী মরগুবা খাতুনের ছিল হাঁস মুরগি, গরু পালার শখ। ১৫/২০টা ভেড়া ছিল তাঁদের। ৯টা কুকুর আর ১১টা বিড়ালও ছিল পোষা। একটি পোষা বেজি ছিল। তারা যখন ১০ নম্বর বাংলোতে ছিলেন তখন তাদের পাশের বাংলোতে ছিলেন পদার্থবিদ্যার বোস-আইনস্টাইন থিয়োরির জনক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বোস। বাবার ভাষায়, ‘তিনি সারাক্ষণ বিজ্ঞানের চিন্তায় মশগুল থাকতেন। মাথায় উষ্ক খুষ্ক চুল। প্রায়ই দেখতাম দুপায়ে দু রকম জুতো পরে আনমনে হেঁটে যাচ্ছেন’। শহীদুল্লাহ ও সত্যেন বোসের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিল খুব বন্ধুত্ব। সত্যেন বোসের মেয়ে জোৎস্নাদির কাছ থেকে বাবা প্রায়ই গানের রেকর্ড চেয়ে আনতেন। জগন্ময় মিত্র, কে এল সায়গল তখনকার দিনের জনপ্রিয় গায়ক।
১৯৪৩ সালে বাবা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ঢাকায় তিনি প্রচুর গোরা সৈন্য ও টমি দেখেছেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের বলা হতো গোরা সৈন্য এবং আমেরিকানদের টমি। ঢাকায় তখন তেতাল্লিশের মন্বন্তর চলছে। ব্রিটিশের ভ্রান্তনীতির ফলে ধানের ফলনের জন্য বিখ্যাত পূর্ববাংলা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে চাল। মানুষ মরছে না খেয়ে। একটু ভাতের জন্য ঢাকা ও কলকাতার পথে পথে তখন দুর্ভিক্ষপীড়িত বাঙালির শবদেহ। সেসময়ই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তার বিখ্যাত ছবিগুলো আাঁকেন।
বাবা তখন সদ্য তরুণ। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিখ্যাত লেখক ও সমাজকর্মী এবং কমিউনিস্ট নেতা রণেশ দাশগুপ্ত এবং কমিউনিস্ট নেতা নেপাল নাগ ছিলেন বাবার প্রথম দীক্ষাগুরু।
এখানে বাবার সামান্য পরিচয় দিই। আমাদের সমাজে কোনো কোনো মানুষ আছেন যাঁরা তাঁদের সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শের আলোয় চারপাশকে আলোকিত করেও রয়ে যান প্রচারের পাদপ্রদীপের আড়ালে। ফোকাসের বাইরে থাকা এমনি একজন মানুষ মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনকে যারা সংগঠিত করেছেন এবং সেই আন্দোলনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি তাঁদের অন্যতম। তিনি এদেশের বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে। ১৯৪৮ এর ভাষা আন্দোলনের যে চারটি মাত্র আলোকচিত্র পাওয়া যায় সেটিও তারই তোলা। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। তার আগেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন। ১১ মার্চের ভাষা আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম নেতা।
১৯৪৯ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং তার নামে হুলিয়া বের হয়। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেপ্তারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।
আমাদের জাতীয় মুক্তির ইতিহাস, তেভাগা আন্দোলন, নাচোল বিদ্রোহ, পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতার ভিতরে প্রাণপণ শক্তিতে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টায়রত কমিউনিস্ট কর্মীদের ইতিহাস যখন পড়ি, আমি আমার বাবার তরুণ বয়সের চেহারাটি যেন ঠিক দেখতে পাই। পবিত্র মন্ত্রের মতো একা একা আমি উচ্চারণ করি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ ঠিক তখন সেই স্লোগানে আমি বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। কৃষক-শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাঁকে দেখি, তাঁকে দেখি কমিউনিস্ট পার্টির রক্তপতাকার ভিতর।
১৯৫১-৫৫ সাল পর্যন্ত বাবা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী ছিলেন। আরও বিভিন্ন সময় তিনি কারবরণ করেছেন।
বাবা সারাজীবনই ছিলেন ত্যাগী মানুষ। তিনি সমাজসেবা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। আমার জীবনে আমি বাবার মতো ধৈর্য্যশীল ও মানবিকগুণসম্পন্ন মানুষ দেখিনি।ছোটবেলায় দেখতাম আমাদের পুরান ঢাকার বাড়িতে মহল্লার রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রী, তরকারি বিক্রেতাসহ সব পেশার মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল। যে কোনো প্রয়োজনে অথবা এমনিতেই বাবার সঙ্গে সুখদুঃখের আলাপ করতে এরা আসতেন। ড্রইংরুমের সোফায় বসে চা নাস্তা খেতেন। বাবা তখন জুটমিলে চাকরি করতেন।বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে ঢাকা জুটমিলে তার অফিস। সেখান থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যার পর বাড়িতে তিনি বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম চালাতেন বিনা বেতনে। নিজের খরচে ছাত্রদের বই খাতা কিনে দিতেন। রিকশাওয়ালা, রাজমিস্ত্রী, মাংসবিক্রেতার সহকারী এরা ছিল তার ছাত্র। তিনি নিজের উদ্ভাবিত সহজ শিক্ষা পদ্ধতিতে এদের লেখাপড়া শিখাতেন। শীতের সময় অনেকদিন দেখেছি বাবা তার নিজের কোট, সোয়েটার কোনো গরীব ছাত্রকে দিয়ে দিয়েছেন।
বাবা আশি সাল পর্যন্ত জুটমিলে চাকরি করেন। তিনি মিলের পারচেজ ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন। বাবার অনেক নিচের গ্রেডের কর্মকর্তাও সে সময় পারচেজে চাকরি করে ঢাকায় দুতিনটে বাড়ি করে ফেলেছে। কিন্তু তিনি এক পয়সাও ঘুষ খাননি। সেটা নিয়ে কোনো অহংকারও করতেন না। মা যদি কখনও বলতেন যে, তুমি তো কখনও ঘুষ নাওনি। বাবা মৃদু হেসে বলতেন ‘ঘুষ খাবো না এটাই তো স্বাভাবিক। যদি ঘুষ নিতাম সেটাই হতো অস্বাভাবিক। স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে আবার বলে বেড়াতে হবে কেন।’ আমার প্রবাসী চাচা আবুল বায়ান নকীয়ূল্লাহর সঙ্গে তিনি কয়েক বছর ব্যবসা করেন। সেসময় তার একটি দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। রাস্তায় একটি পথশিশুকে গাড়িচাপা পড়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে তার ডান হাত ভেঙে যায়। সেজন্য কয়েকমাস তাকে ঘরে বসে থাকতে হয়। ফলে ব্যবসা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ব্যবসা ছেড়ে তিনি পুরোপুরি বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরির গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন।
বাংলাদেশে যারা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ফটোগ্রাফির চর্চা করেছেন তিনি তাদেরও অন্যতম। তার তোলা আলোকচিত্র দেশে বিদেশের অনেক প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে।তিনি মূলত শ্রমজীবী মানুষের ছবি তুলেছেন। গুনটানা, গরুর গাড়ির গাড়োয়ান, মাছ ধরা ইত্যাদি অনেক ছবি তুলেছেন তিনি।
তার নিজের চাহিদা ছিল খুব সামান্য। খাবার দাবার কোনো কিছু নিয়ে কিছুই কখনও বলতেন না। হয়তো আলু সিদ্ধ বা ডিমভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে উঠতেন। তরকারির ভালো মন্দ নিয়ে কোনো অভিযোগই করেননি কখনও। নিজের থালাবাটি নিজেই ধুতেন। এমনকি নিজের পরনের কাপড়ও নিজে হাতে ধুয়ে রাখতেন। কারও সাথে কখনও রাগ করতেন না। আমি এবং আমার ভাই বাবার কাছে কখনও বকা খাইনি, মারের তো প্রশ্নই ওঠে না। আমার মাকে খুব সম্মান করতেন। তার সঙ্গে সব সময় দেখেছি খুব ভদ্রভাবে কথা বলতে। মা কোনো বিষয় নিয়ে রাগ করলে বা অস্থির হলেও বাবা ধৈর্য্য হারাতেন না। এমনকি বৃদ্ধ বয়সে আমার মায়ের(যিনি মানসিকভাবে অসুস্থ) সেবায় তিনি রাতের পর রাত ঘুমাননি।
কাজের লোক, পিয়ন দারোয়ান, অফিসের কর্মচারী কারও সাথেই কোনোদিন তিনি বিন্দুমাত্র দুর্ব্যবহার করেননি। তাদের প্রত্যেকের সাথেই বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন। এমনকি বাড়ির সুইপারের সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব ছিল। এ নিয়ে মা ঠাট্টা করে বলতেন, ‘তুমি খানবাহাদুরের জামাই হওয়ার অনুপযুক্ত। বাবা হাসতেন, বলতেন, ‘আমি তো কমিউনিস্ট’।
অজাতশত্রু শব্দটি তার বেলায় ছিল দারুণ লাগসই। চেনা পরিচিত, আত্মীয়স্বজন কোথাও তার কোনো শত্রু ছিল না। এমনকি তিনি যখন রাজনীতি করতেন তখন তার বিরোধী মতের মানুষরাও ব্যক্তিগতভাবে তাকে পছন্দ করতেন। তার সহজ সরল ও সকলের প্রতি আন্তরিক ব্যবহারই ছিল তার কারণ।
তার দৈহিক শক্তি ছিল প্রচণ্ড। বাড়িতে দুটি ডাম্বেল ছিল। সে দুটি ছিল ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ব্যবহৃত। বাবা ওই ডাম্বেল দিয়ে ব্যায়াম করতেন। তার বাইসেপ ট্রাইসেপ ছিল দারুণ সুগঠিত। মধ্যম উচ্চতার মানুষ। সুগঠিত মেদহীন দেহের অধিকারী। একমাথা ঢেউ খেলানো চুল। আমাকে ব্যায়ামের খেলা দেখাতেন। তিনি কারাটি চপে কাঠের তক্তা ভাঙতে পারতেন। নারিকেল ভাঙতেন কিল দিয়ে। প্রায়ই বাড়ির ফার্নিচারগুলো এ ঘর থেকে ও ঘরে নিতেন। যেটা ছিল শোবার ঘর সেটা হয়তো বসার ঘর হয়ে গেল। এটা ছিল তার শখ। ভারি ভারি আলমারি ও অন্যান্য ফার্নিচার নিজেই টেনে সরিয়ে দিতেন।
ছোট কালো একটি অস্টিন গাড়ি ছিল আমাদের। বাবা নিজেই গাড়ি চালাতেন। মোটর সাইকেলও চালাতে পারতেন তিনি। ধূমপান করতেন না কখনও, মদ্যপানও নয়। বাবা চা খেতেন না। সকালে এক কাপ ওভালটিন মেশানো দুধ খেতেন। আমাকে তিনি কার্ল মার্কস ও লেনিনের গল্প বলতেন। সমাজতন্ত্রের আদর্শ খুব সহজ ভাষায় গল্প বলে বুঝাতেন। তার জেলজীবনের কথা, আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনের কথা, মজার স্মৃতি সবকিছু। কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, অনিল মুখার্জি, সন্তোষ গুপ্ত, মোহাম্মদ মোহাইমেন, মোহাম্মদ সুলতান, সরদার ফজলুল করিমসহ(এঁরা সকলেই বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের স্মরণীয় নেতা) অনেক পুরানো কমরেডচাচাদের বাড়িতে আসতে দেখতাম। বৃদ্ধবয়সেও প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শহীদুল্লা কায়সার এবং অন্য শহীদ বন্ধুদের স্মরণ করতেন, তাদের জন্য কাঁদতেন। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন ৯১ বছর বয়সে। মৃত্যুর এক বছর আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আশি পঁচাশি বছর পর্যন্ত তিনি ছিলেন সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। পরিমিত জীবনযাপনই ছিল এর কারণ। বাবা খুব ধর্মপরায়ণও ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। প্রতিদিন কোরআন শরীফ পড়তেন। রোজা রাখতেন। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে অনেকসময় দেখতাম তিনি নামাজ পড়ছেন। শিশুর মতো সরল ছিলেন। আমি নামাজ পড়া শিখেছি বাবার কাছে। তিনি তার ঈশ্বর বিশ্বাস ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ দুটোতেই নিষ্ঠাবান ছিলেন। মৃত্যুশয্যাতেও তিনি তাঁর পুরনো কমরেডদের কথা বলতেন।
আমি এখনও মাঝে মাঝে রাতের আকাশের দিকে তাকাই। জীবন পথে পেরিয়ে এলাম তো অনেকটা পথ। ঢাকা শহরের কত পরিবর্তন হলো, কত বদলে গেছে আমার নিজের জীবনধারাও। তবু ছোটবেলায় বাবার চিনিয়ে দেয়া সেই তারাগুলো একই রকম আছে। ছোটবেলায় শুনেছিলাম মানুষ মৃত্যুর পর আকাশের তারা হয়ে যায়। এখনও আকাশভরা তারা। বাবা কোন তারাটা তুমি?
(লেখক: শান্তা মারিয়া, কবি ও সাংবাদিক)