শুক্রবার,

১৮ অক্টোবর ২০২৪

|

কার্তিক ২ ১৪৩১

XFilesBd

শিরোনাম

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু শনিবার উজানের দেশগুলোর কাছে বন্যা পূর্বাভাসের তথ্য চাওয়া হবে : পানি সম্পদ উপদেষ্টা নোয়াখালীতে পানি কমছে, ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টে রিট দেশের ১২ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে অপসারণ শেখ হাসিনা মেনন ইনুসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হত্যাকান্ড, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিচার হবে নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও করে না : প্রধানমন্ত্রী সাবেক আইজিপি বেনজীরের সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ আদালতের হবিগঞ্জের কার ও ট্রাকের সংঘর্ষে নারীসহ নিহত ৫ যুদ্ধ ব্যয়ের অর্থ জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবহার হলে বিশ্ব রক্ষা পেত: প্রধানমন্ত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী প্রাণি ও মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর বিএনপি নেতারা সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দেওয়ার অপচেষ্টা করছে : ওবায়দুল

অতলান্ত পূব, প্রশান্ত পশ্চিম 

মাহমুদ হাফিজ

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ১১ অক্টোবর ২০২৪

অতলান্ত পূব, প্রশান্ত পশ্চিম 

আলাস্কা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ওয়ান ফোর সিক্স ওয়ানে যথাসময়ে বোর্ডিং শুরু হয়েছে। আসন নম্বরের সিরিয়াল মেনে নাম ডাকা হচ্ছে। আমাদের আসন বিজনেস ক্লাশের পেছনের সারিতেই। তুসুর আসন পড়েছে পিছনে। স্লিমদেহী এয়ারবাস থ্রি টু জিরোর দু’দিকের জানালাঘেঁষে তিনটি করে আসন, মাঝের আসনগুলের দুই পাশ দিয়ে চলাচল। বিমানে উঠে দেখি আমাদের সারির আয়েল আসনে আসন নিয়েছে ভ্রমণসঙ্গী জলির চোখের যম ‘ওগো বিদেশিনী’। এয়ারক্রাফট স্লিমদেহী হলেও আসনগুলো কোসাদা। ইস্তাম্বুল-সানফ্রানসিস্কো ফ্লাইটে ভাগ্যক্রমে জলি স্বামীকে সুরক্ষিত করতে পারলেও এখানে তা অসম্ভব। কারণ আমাদের আগেই নিজ আসনে আসন গেড়ে বেসেছে শ্বেতসুন্দরী। জলি আজকের মনোরম বিকালটি পাখির চোখে পাহাড় বন বনানী আর সমুদ্র দেখতে চায়। চোখে তেরচা নজর জারি রেখে মাঝের আসনটি আমাকে ছেড়ে দেয়। নিজে জানালার কাছে গিয়ে বসে। আমাদের আমেরিকা যাত্রাপথের শেষ ফ্লাইটে এ কান্ডে আমি ভরশ্রাবণেও কবি নজরুলকে স্মরণ করি- ‘পরাণ প্রিয়….কেন এলে অবেলায়’।

‘ওগো বিদেশিনী’র বয়স বোঝার উপায় নেই। এয়াক্রাফটের মতোই চিকনদেহী। চেহারার কমনীয়তা কবেই উধাও, আহামরি দর্শনধারীও নয়। এটাই জলির শান্ত্বনা। সামনের আসনলগ্ন সকেটে চার্জার ঢুকিয়ে আইপ্যাডে মগ্ন সে। আসন নেয়ার সময় ‘এক্সিউজিম মি’ বললে শুধু ‘ওহ সিওর’ বলে উঠে দাঁড়িয়েছে। মোবাইল চার্জ করতে কোন সকেটে চার্জার ঢুকাবো এ নিয়ে আমার দোনোমোনো দেখে ‘ইউ ক্যান পুট ইট অন টপ অফ মি’ বললে আমি ভড়কে যাই। পরে বুঝতে পারি প্যানেলের দুটি সকেটের নিচেরটিতে সে চার্জ দিচ্ছে, আমাকে ওপরেরটিতে চার্জার লাগাতে বলছে।  আমাদের মধ্যে কথা ওই দুই বাক্যই। আর কোন কথা নেই। আসনসঙ্গীর সঙ্গে সচরাচর আলাপ জমাতেই পছন্দ করি আমি। কিন্তু কোন নারীসঙ্গীওলা ভ্রামণিকের পৃথিবীর কোন নারী আর আলাপ জমাতে চায়! তাই সে আলাপ বৃথা। আমি বামপাশে নিজ নারী, ডানপাশে পরনারীর মাঝখানে চিড়ে চ্যাপ্টা হচ্ছি।

থিতু হয়ে জুস কফি খাওয়ার মধ্যেই ল্যান্ডিংয়ের জন্য নিচে নামতে শুরু করেছে বিমান। ঘন্টা দুয়েকের উড়ালশেষে সিয়াটল তাকোমা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে আমি দ্রুত এক্সিটের দিকে হাঁটা দিই। জলি ও তুসুকে দ্রুত পা চালাতে বলি। কাস্টমস ইমিগ্রেশনের ঝামেলা আগেই গুজার গিয়া। বিমানের ভেতরে থাকতেই আলাস্কা এয়ারের কোকিলকন্ঠি বলে দিয়েছে- থ্রি ফোর সিক্স ওয়ানের লাগেজ পাওয়া যাবে ১৫ ও ১৬ নম্বর বেল্টে। বেল্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতেই লাগেজ এসে হাজির। ভাবি, এটা আমাদের দেশ না। অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। লাগেজগুলো নামিয়ে এক জায়গায় জড়ো করে আমি মোবাইলে রোমিং নম্বরটি সচল করি। সিয়াটলে আমাদের মেজবান মি. পল কে বার্তা দিই-‘ উই হ্যাভ এ্যারাইভড’। পরক্ষণেই ফিরতি  বার্তা পাই ‘আই এ্যাম ড্রাইভিং, জাস্ট ফাইভ মিনিটস’।
টেনশনপ্রিয় মন আমার প্রশান্ত উপকূলের তাকোমা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে শান্ত থাকে।  

আজকাল ভ্রামণিকদের জন্য হোটেলের ঘড়িবাঁধা জীবন ছাড়াও এয়ার বিএনবি, কাউচ সার্ফিংয়ের মতো এ্যাপসভিত্তিক ব্যবস্থা বিদেশে বসবাসের নানারকম বন্দোবস্ত করেছে। তাতে দিন মাস ক্ষণ সময় বেঁধে থাকা যায়। হোস্টগণ এয়ারপোর্ট থেকে নবাগত ভ্রামণিককে রিসিভও করে থাকেন। আমাদের সম্পর্ক ভিন্নধর্মী, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’র মতো। সময়কেন্দ্রিক বাঁধাধরা নিয়ম সেখানে অচল। এসেছো যখন এ নগরে, থাকো যতোদিন ইচ্ছে- গোছের। কিছুক্ষণ পরই মি. পলের উদয়। দীর্ঘ সম্পর্কের সূত্রধরে বিমানবন্দরের অগুণতি মানুষের ভিড়ের মধ্যেই অনায়াসে চিনতে পারি আমরা। কিছু সময় কাটে শুভেচ্ছা বিনিময়ে, আবেগমথিত মানবীয়বোধে।

লাগেজসহ পলের সঙ্গে চৌদ্দ নম্বর এক্সিট দিয়ে বের হয়ে ড্রাইভওয়ের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। পলের বন্ধু সিনা ও রকিও এসেছে আমাদের রিসিভে সহায়তা করতে। পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে এয়ারপোর্টের ভেতরে এসেছে সে আমাদের অভ্যর্থনায়। তার বন্ধুরা বাইরে চক্কর দিচ্ছিলো,, ফোন পেয়ে  বিশালবপু গাড়ি নিয়ে হাজির চোখের পলকে। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর সিনা-রকির গাড়ির পেছনে ছোট বড় নয়টি লাগেজ তোলা হয়। রকি আর পলই ধরাধরি করে লাগেজগুলো তোলে, আমাদের হাত লাগাতে হয়নি। ভাবটা এমন যে, সব ভার, চাপ আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। বিশালবপু গাড়ি আপত্তি ছাড়াই ঢাউস লাগেজগুলো পেটে ভরে নেয় পরম যত্নে। সঙ্গের হাতব্যাগগুলো  নিয়ে আমরা পলের সঙ্গে পার্কিংলটের দিকে হেঁটে চলি। অপেক্ষমান তার ব্রান্ডনিউ হোন্ডা। বাড়িতে স্বাগত জানাতে অপেক্ষমান গৃহবন্ধু মিসেস জেরিন। এ নগরে দম্পতির প্রার্থিত মেহমান আমরা। সিয়াটলে পৌঁছেই রাজকীয় কেতার আতিথ্যে ভাবি, বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি-উবার ভাড়ার ঝামেলা আমাদের জন্য নয়।

তাকোমা থেকে সিয়াটল ডাউনটাউনকে বাইপাস করা ফ্রিওয়ে ফোর ও ফাইভ ধরে ড্রাইভ করে পল ১৮ নম্বর এক্সিট নেয়। আগে থেকেই জানি তার বাসা স্নোহোমিশ কাউন্টির লিনউড নেইবারহুডে। পৌণে একঘন্টার ড্রাইভে  বাসায় পৌঁছে দেখি সিনা-রকি দম্পতি লাগেজ নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ল্যান্ডিংয়ের সময় আকাশ মেঘলা দেখেছি। আসার সময় গাড়ির গ্লাসেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে দেখেছি। লিনউডে সেই গুঁড়ি একটু বড় ও ঘন হয়েছে। ভাবি, প্রশান্ত মহাসাগরসংলগ্ন ওয়াশিংটন স্টেটের সিয়াটল শহরে বৃষ্টিপ্রবণ বলে শুনেছি, আজ সেই বৃষ্টিই কি আমাদের স্বাগত জানাতে এলো?

আমাদের ভ্রমণক্লান্ত শরীরকে বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে সিনা ও রকি আর অপেক্ষা করলো না। ডুপ্লেক্স বাড়ির গ্যারেজটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গাড়ি পার্ক করে পল। লাগেজগুলো প্রশস্ত গ্যারেজে ঢুকিয়ে বামপাশে দরজা দিয়ে আমরা তার সঙ্গে বাড়িতে ঢুকি। নিচতলায় কাউকেই দেখতে পাই না। কয়েক মিনিটের মধ্যে দোতলা থেকে ত্রস্তপায়ে হৈ হুল্লোড় করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে গৃহকর্ত্রী জেরিন। জলিকে জড়িয়ে ধরে। পল, তুসু আর আমি থ’ হয়ে  যাই। যেন এ আবেগ জন্মজন্মান্তরের সম্পর্কের।  

ভ্রমণক্লান্ত শরীর, বাইরের বৃষ্টি আর রাতের আঁধারের কারণে মার্কিন মুলুকের এই অচেনা শহরে আমাদের নয়া অতিথিশালাটি পুরো দেখতে পারি না। ভ্রমণঘোরের মধ্যেই টেবিলে পরিবেশিত পাঁচপদের তরকারি দিয়ে রাতের খাবার খাই। গৃহকর্ত্রী জেরিন জলি ও আমার শয়ন কক্ষটি দেখিয়ে দেয়। দোতলার শয়ন কক্ষ আর বাথরুম দেখে আমাদের আশ্চর্য হওয়ার পালা। পেশাগত জীবনে  পাঁচতারকা মানের হোটেল স্যুটের অতিথি হয়েছি অগুণতিবার। কিন্তু এই প্রশস্ত নতুন খাট, মোটা গদির পরিপাটি শুভ্র বিছানা, দুই আসনের সোফা, জানালালাগোয়া রিডিংটেবিল, সবুজরঙা ভেলভেটে মোড়ানো চেয়ার, রিডিং লাইট, দেয়ালঘড়ি, এ্যালার্ম ক্লক, সবুজ ইনডোর প্ল্যান্ট, বড়সড় ক্লজেটে গোটা বিশেক হ্যাঙ্গার, লাইফসাইজ মিরর, খাটের দুই পাশে সাইডটেবিলে নতুন থার্মোফ্লাস্কে খাবার পানি, সবার জন্য আলাদা আলাদা ছোট ও বড় তোয়ালে, বাথরুমে সোপ, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, স্ক্রাব, ফেসওয়াস, লোশন, মাউথওয়াশ, সেন্ট, বডিস্প্রে, শেভিং ক্রিম, হ্যান্ডওয়াশের বিপুল সম্ভার কোন পাঁচতারকায় মেলে ? উপর্যুপরি এখানে নেই ঘড়ি ধরে চেক ইন চেক আউটের তাড়া। পল-জেরিনের অতিথিসেবার বিপুল আয়োজন দেখে আমাদের চোখে পানি চলে আসে। মেজবান দম্পতির বাড়ি ও মেহমানদারির আরও এন্তেজাম আগামীকালের জন্য তুলে রাখি। পঞ্চাশঘন্টার পরিভ্রমণক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেই কোমল বিছানায়।

দুই.
সকালে উঠে দেখি গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি । পূবের জানালায় সূর্যের দেখা নেই। রাস্তায় গাড়িও নেই তেমন। যে বাড়িতে এসে উঠেছি, এর পূর্বদিকে উত্তর-দক্ষিণ লম্বা রাস্তা। রাস্তা ডিঙিয়ে পূর্বদিকে তাকালে কয়েকটি ডুপ্লেক্স  বাড়ি। আমাদের দেশের বাংলো প্যাটার্ণের । ছাদগুলো চারচালা। করোগেট টিনের বাড়ি স্টাইলের, ওপর থেকে নিচের দিকে নামানো। শীতকালে বরফ পড়ে বলে কোন ছাদই আমাদের মতো সমান নয়, চারচালা ঘরের মতো বাঁকানো। কোন স্থপতি আমেরিকানদের এই্ বাড়ি বানানো শিখিয়েছে আল্লাহ মালুম। বাড়ির কাঠামো ভিন্ন হলেও দেখতে প্রায় একই রকম । বিস্তীর্ণ সবুজের মধ্যে এসব সাদা, ছাই বা হাল্কা খয়েরি রঙের বাড়ি নজর কাড়ে বড়। শান্ত সকালে যতোদূর চোখ যায়, সবুজের মধ্যে বাড়িগুলো আমার চোখে প্রশান্তি দেয়  সিয়াটলে দ্বিতীয় দফা ভ্রমণের এই প্রথম সকালটিতে।  

পাহাড়, টিলা ও সবুজ বনানীময় লিনউইড এলাকাটিই দৃষ্টিনন্দন। এর পেছন দিয়ে চলে গেছে ফোর ও ফাইভ ফ্রি ওয়ে।  অদূরেই মিলেছে তা আই ফাইভে। এই আই ফাইভ বা ইন্টারস্টেট ফাইভ রাস্তাটি আমেরিকার সঙ্গে মেক্সিকো ও কানাডার মতো প্রতিবেশি  দেশকে যুক্ত করেছে। মেক্সিকো সীমান্তের চুলাভিস্তা থেকে শুরু হয়ে প্রশান্ত পশ্চিমের সব উপকূলীয় শহর ছুঁয়ে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার গিয়ে পৌঁচেছে। পথে সান্দিয়েগো, লস এঞ্জেলেস, সানফ্রানসিস্কো, স্যাকরামান্টো, ইউজিন, পোর্টল্যান্ড, সিয়াটলকে ছুঁয়ে গেছে। একটা মাত্র রাস্তা দিয়ে উত্তরে কানাডায় আর দক্ষিণে মেক্সিকোয় যাওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সড়ক নেটওয়ার্কের ঘনবন্ধনকে প্রমাণ করে।

নিচে আসি। আস্তে আস্তে বাড়ির সবা্‌ই ওঠে। রসুইঘর থেকে শব্দ আসে: ‘ নো অনিয়ন, নিড অনিয়ন’ মানে বাড়িতে পিঁয়াজ নেই। গৃহকর্তা কথা না বলে গাড়ি বের করেন। বাড়িতে প্রার্থিত অতিথি। গুঁড়িবৃষ্টির সকালে আলস্য ভেঙে তাঁকে বেরুতেই হয় বাজারে। বাজার বলতে চটের হাতে কাওরান বাজার বা মালিবাগ বাজার নয়, সুপার মার্কেট। এশিয়ায় পথে ঘাটে দোকান বাজার। অনায়াস জীবনযাপনের জন্য যত্রতত্র থেকে রসদ সংগ্রহ চলে। এখানে ডেবিট ক্রেডিট কার্ড নিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে দৌড়াতে হয় চেইন সুপারশপে। এশিয়ার সঙ্গে পুঁজির প্রতাপশালী ভোগবাদী মার্কিনী সমাজের ফারাকটি এখানেই চোখে লাগে।

গৃহকর্তা বাড়ির সামনের গ্যারাজদরজা মোবাইল টিপে খোলেন। আস্তাবল থেকে হোন্ডা নামের ঘোঁড়াটি বের করেন। আমাকে বাজারে যাওয়ার আহবান জানালে গাড়িতে উঠে বসি। বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন ও আলু পটল কেনার আটপৌরে সাংসারিকজীবনের মধ্যে সমতাবিধানে বাজার করাকেই জীবনের সখ হিসাবে বেছে নিয়েছি। বাজারে যাওয়ার আহবানকে তাই লুফে নিই। গৃহকর্তার ঘোঁড়াটি মসৃণ সড়ক ধরে দৌড়াতে থাকে।

আবিস্কার করি, আমাদের হোস্টের বাড়িটি পাহাড়-টিলার ওপর এক চমৎকার লোকেশনে। বাড়িটির সামনে উত্তর দক্ষিণ লম্বা রাস্তার দু’দিক থেকে বের হয়ে আশপাশের শপিং ও রিক্রিয়েশন এরিয়াগুলোতে যাওয়া যায়। দুদিক দিয়েই গাড়িতে ৪/৫ মিনিটের দূরত্ব। বাড়ি থেকে বামে গেলে পাহাড়ি ঢালু রাস্তায় দু’দিকের নয়ানাভিরাম বাড়িগুলোকে গুডবাই জানিয়ে নেমে যেতে হয় লুকাস্টওয়েতে, তারপর ফিলবার্ট রোড নামের বনানীময় এক নেইবারহুডের সড়ক। ডানে গেলে সামান্য ঢালুতে নেমে ড্যামসন সড়ক হয়ে ওঠা যায় অন্য সড়কে।  জায়গাটি পকেট মতো হওয়ায়  নিরিবিলি, শান্ত ও চাপমুক্ত।

গাড়িতে উঠে বুঝতে পারি মার্কিনীদের মতোই এখানে রাস্তা গাড়ির গতি আমাদের দ্বিগুনেরও বেশি। নেইবারহুডের রাস্তাতেই তা চলে কমপক্ষে ৭০ কিলোমিটার বেগে। বড় রাস্তায় গেলে কমবেশি ১৩০ কিলোমিটার বেগ পায় গাড়ির। মোদ্দাকথা, এরা নতুন গাড়ি ব্যবহার করে, রাস্তায় ব্রেক করার প্রয়োজন হয় না তাই এই খরগোশগতি। আমি সীটবেল্ট বেঁধে গাঁট হয়ে বসি।

এশিয়ান -বিশেষ করে মসলাদার খাদ্যরসিক অতিথি আসায় গৃহকর্তা আপামর মার্কিনীদের বাজারগন্তব্য ‘কস্টকো হোলসেল’য়ে যান না, চলে যান এশিয়ান মাছ মসলা শাকসব্জি পাওয়া যায় এমন সুপারশপে। সিয়াটলে জাপানী-কোরিয়ানরা এইচ মার্কেট, এশিয়ান মার্কেট নামে এশিয়ান খাদ্যসম্ভারে এন্তার সুপারশপ গড়ে তুলেছে। ভারতীয়রাও কম যায় না। এ নগরে ভারতীয় মসলা মাছের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছে ‘ময়ূরী’নামের সুপারশপ। এতে শুধু ভারত পাকিস্তান নয়-  বাংলাদেশের মাছ, মশলা, নাড়ু, চানাচুর সবই মেলে। বাসায় এখন যেহেতু পিঁয়াজ দরকার, গৃহকর্তা স্বগতোক্তিতে বললেন-‘ময়ূরীতেই আজ যাই’।  

পৌঁছে দেখি এলাহী কান্ড। ইচ্ছে থাকলে এখানে হয়তো মুক্তাগাছার মন্ডা, কুমারখালীর দই আর কুমিল্লার রস মালাইও মেলানো যায়। পিঁয়াজ, বিস্কুট, বেগুনসহ কিছু সবজি চটজলদি কিনে নেন গৃহকর্তা। একই পথে ফিরে আসি।   এখানে একটু বেলা করে নাস্তা খাওয়ার চল। দিনে রাতে মেইন কোর্সটি এক বা দু’বার খাওয়া হয়। দিনমান চলে শুকনো খাবার, ফলমূল। আমরা ফিরে এসে নাস্তা খাই। বৃষ্টি ধরে এলেও আকাশ মেঘমুক্ত হতে চায় না। বৃষ্টি চলে গেলে সবাই ব্যাকইয়ার্ড বা গৃহঅন্দরে হাটাহাটি করে। এ বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডটি একটু বেশিই বড়। আমাদের হিসাবে কমপক্ষে আটকাঠা আয়তনের। সবুজ ঘাসে ছাওয়া। একপাশে গৃহকর্ত্রী জেরিনের সখের গোলাপফুলের তিনটি টব। একপাশে বুনোফুলের ঝোঁপ। বড় একটা বৃক্ষও আছে ব্যাকাইয়ার্ডে।

সীমানাদেয়ালের পিছন বা পশ্চিম দিকের বাগানে থোকায় থোকায় ব্লবেরি ঝুলছে। তার শাখা বিস্তৃত হয়েছে কাষ্ঠনির্মিত সীমানা দেয়ালের ওপরে। রসভারে নত টসটসে ঘন বেগুণী রঙ ফলপ্রিয় ফুডিকে হাতছানি দেয়। মার্কিনমুলুকে ট্রেসপাসিং বা অনঅধিকার প্রবেশ নাজায়েজ। বাড়ি বা জমিওলা গুলিও করে দিতে পারে। স্পর্শরহিত ফলবৃক্ষের বাগানটি এ্যাজমালি বলে তাতে সবারই অধিকার। তাই হাতছানি দেয়া রসমঞ্জুরি যদি কেউ কব্জাও করে কারও কিছু বলার কিছু । 

আমার গৃহবন্ধু জলিকে দেখি গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে পাকাফল তুলে খাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা। এতো দামি ফল যেচে বাড়ির সীমানা দেয়ালে এসে রসভার মেলে ধরেছে। হাত দিয়ে পেড়ে খাওয়ার আনন্দ আলাদা। আমি দূর থেকে বলি ধুয়ে নাও। আর আল মাহমুদ এর কবিতার ভাষায় ‘ তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিয়ো সেই ফল’ উচ্চারণ করি। মুহুর্তেই আমার হাতে চলে আসে দুয়েকটি। খেয়ে দেখি, টকমিষ্টি। বলি আরও কয়েকটি দাও। ভাবি, এই ফলের নামেই বুঝি বৃটিশ ফোন কোম্পানির নাম হয়েছিল ব্লবেরি। আজকাল অবশ্য ওই নামটি কম শোনা যায়।

বিলগেটস এর কোম্পানি মাইক্রোসফট এর পক্ষ থেকে উইন্ডোজ ১১ প্রকল্প কমপ্লিট করায় ইডেন নামে একটি দামি ড্রিংক এসেছে গৃহকর্তার নামে। ভারমন্ট আইস সিডার। হানি ক্রিসপ। গৃহকর্তা আমাকে ও তুসুকে অফার করে। আমরা চুমুক দিয়ে বড় মজা পাই। দামি আপেল থেকে নাকি তৈরি। সারসগলা বোতলটি দেখতেও বেশ।

দুপুর গড়াতেই সূর্য সমস্ত অভিমান ত্যাগ করে হেসে ওঠে। বাড়ির সামনে ও গৃহঅন্দর তীর্যক আলো পড়লে চারপাশ ঝলমলিয়ে ওঠে। সবুজ ব্যাকইয়ার্ড হয়ে ওঠে কাকলিময়। 

(বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহমুদ হাফিজ কবি ও লেখক, দেশের প্রথম গদ্য আলেখ্য ভ্রমণগদ্য পত্রিকার সম্পাদক)