মঙ্গলবার,

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

|

আশ্বিন ১ ১৪৩১

XFilesBd

শিরোনাম

উজানের দেশগুলোর কাছে বন্যা পূর্বাভাসের তথ্য চাওয়া হবে : পানি সম্পদ উপদেষ্টা নোয়াখালীতে পানি কমছে, ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টে রিট দেশের ১২ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে অপসারণ শেখ হাসিনা মেনন ইনুসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হত্যাকান্ড, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিচার হবে নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও করে না : প্রধানমন্ত্রী সাবেক আইজিপি বেনজীরের সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ আদালতের হবিগঞ্জের কার ও ট্রাকের সংঘর্ষে নারীসহ নিহত ৫ যুদ্ধ ব্যয়ের অর্থ জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবহার হলে বিশ্ব রক্ষা পেত: প্রধানমন্ত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী প্রাণি ও মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর বিএনপি নেতারা সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দেওয়ার অপচেষ্টা করছে : ওবায়দুল

উচ্চশিক্ষাবিস্তারে কয়েকটি বৈপ্লবিক-চিন্তা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

ড. শেখ রজিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:১৯, ২৮ আগস্ট ২০২৪

উচ্চশিক্ষাবিস্তারে কয়েকটি বৈপ্লবিক-চিন্তা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

উচ্চশিক্ষাবিস্তারে কয়েকটি বৈপ্লবিক-চিন্তা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা

পৃথিবীর ইতিহাসে যত বড় বড় বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে, তার পশ্চাতে রয়েছে বহু দিবসের, বহু বছরের ক্ষোভ-বঞ্চনার অভিঘাত। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে সংগঠিত ‘ফরাসি বিপ্লব’,‘মে দিবস’ নামে আখ্যায়িত ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে সংগঠিত শ্রমিক বিপ্লব, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় জারের বিরুদ্ধে সংগঠিত ‘রুশ বিপ্লব’, এমনকি  আঠারো শতকের শেষ দিকে ইংল্যান্ডে অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সনাতন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনমুখী বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও যান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহারে রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বৈপ্লবিক পরিবর্তন হিসেবে খ্যাত ‘শিল্পবিপ্লব’ প্রভৃতি মানবজীবনকে কোনো না কোনোভাবে পরিবর্তনমুখিনতার সম্মুখীন করেছেন এনেছে নতুন আধুনিকমুখী এক জীবনব্যবস্থা। 

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ছাত্রদের দ্বারা সংগঠিত গণআন্দোলনকে আমি বিপ্লবের তকমা দিতে চাই। কেননা ছাত্রসমাজ একটি সীমায়িত কোটা-সংস্কার আন্দোলনকে পরবর্তীতে একটি বৃহৎ পরিসরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ দিয়েছে, তাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটি ব্যাপক পরিবর্তনমুখীনতার প্রত্যয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দেলনের প্রতিপাদ্যে সমন্বয়কেরা আসলে চেয়েছে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোয় বিদ্যমান অচলায়তন সমাজের-রাষ্ট্রের মধ্যে বহু কাল ধরে বিরাজমান সব ধরনের অপশাসন, নির্যাতন ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে একটি শোষণহীন, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। 

নিরাপদ সড়কের আন্দোলনেও ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ প্রশ্ন সামনে এনেছিলো এই ছাত্র-তরুণেরাই। তাই তাদের সম্মিলিত দাবিগুলোতে ঘোষিত প্রত্যয়; যাতে রাষ্ট্রনৈতিক সংস্কারই প্রকৃতপক্ষে সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্রকে  আরো সুসংঘবদ্ধ ও সুসংহত করতে পারে। কেননা ঔপনিবেশিক  রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় যারাই রাজনীতি থেকে শাসন-ক্ষমতায় যায়, তারাই  এক পর্যায়ে ‘প্রভু’ বনে যায়। এই প্রভুতন্ত্র এতই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে সেখানে স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও মানুষ স্বাধীনতার মর্যাদা পায় না। জনগণের ওপর ক্ষমতার দাপট প্রদর্শনই প্রতিদিনকার রুটিন হয়ে ওঠে। পেশিশক্তির দাপট, বিচারহীনতা, শোষণ-নির্যাতন-গুম, ঘুষ-দুর্নীতি-অপশাসন, খেলাধুলা-সংস্কৃতিচর্চার শূন্যতায় সবমিলে একটা ভয়ের-ত্রাসের পরিবেশ আমাদের প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিয়েছে কাফকার সেই অন্ধকারময় জগতের কথা। সেই বিভীষিকাময় কাফকার জগৎ থেকে মুক্ত-স্বাধীন পরিবেশে বুকভরে শ্বাস নিতে পারার এই পরিবর্তনশীলতার অসাধ্য সাধন-ক্রিয়ার ঘটনাটিকে তাই আন্দোলন না বলে বিপ্লব বলতে চাই।

বিপ্লব মানে আমূল পরিবর্তন, অভুতপূর্ব জাগরণ, একটা নতুন কিছুর আকাক্সক্ষা। সেই আকাক্সক্ষার মুখাপেক্ষী সমাজ-রাষ্ট্রের আবশ্যকীয় পরিবর্তনমুখীনতার সঙ্গে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাবিস্তার-ব্যবস্থাপনায় কিছু পরিবর্তন বা ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে করতে চাই। প্রস্তাবনাগুলো অনেকটা বৈপ্লবিক মনন-চিন্তার ফলশ্রুতিস্বরূপ; যে দুঃসাধ্য কাজগুলো কেবল এই দল-নিরপেক্ষ সরকারের পক্ষেই সম্ভব। 

প্রথমত, বাংলাদেশে যে বিশাল সংখ্যক পাবলিক বা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেখান থেকে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধ করে দিতে হবে। বিশেষত, যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কেবল ঘোষিত হয়েছে, কার্যক্রম শুরু হয়নি, হয়ত ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে বা হয়নি সেগুলোকে পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নিতে হবে। আর কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলোর ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে, অল্প-সল্প অবকাঠামো গড়ে উঠেছে, এগুলোকে কাছের কোনো বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করে দেওয়া যেতে পারে। 

ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, ময়মনসিংহ প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরো বহুমুখী করে বড়ো করা যেতে পারে। কেননা ২৫ একর বা ৩০ একরের পরিসীমায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে উল্লিখিত পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও যে অনেক পতিত ভূমি পড়ে আছে সেখানে নতুন স্থাপনা তৈরি করে নতুন নতুন সাবজেক্ট খুলে অথবা বিদ্যমান সাবজেক্টের আসনসংখ্যা বাড়িয়ে কিংবা নতুন স্থাপনায় আরেক শিফট চালু করে উচ্চশিক্ষায় আমাদের বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর চাপকে সহজেই আত্মীকরণ করা যেতে পারে। 

আমাদের পাশের দেশ ভারতের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩০/১৪০ করে সাবজেক্ট আছে, এমনকি কৃষি বা মেডিকেল বিষয়ে আলাদা ক্যাম্পাস আছে। এমনিতেই আমাদের বাংলাদেশে বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় চাষযোগ্য ভূমি একদম কম এবং নানা কারণে তা কমে যাচ্ছে। কাজেই চাষযোগ্য ভূমি নষ্ট করে এত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে হাই রাইজ (১০ তলা-২০ তলা) ভবন তৈরি করে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। একইভাবে বিভাগীয় শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বা কাছের কোনো জেলা শহরের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনে আরো ভূমি সংযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের মতো ছোট একটি দেশে এতো বিশ্বব্যিালয়ের সার্বিক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার চাপ গ্রহণে সরকারকে যথেষ্ট হিমসিম খেতে হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয় এবং কোনোভাবেই কোনো র‌্যাংকিংয়ের সরণীতে জায়গা করে নিতে পারে না। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে অভিজ্ঞ শিক্ষক পাওয়া যায় না। লেকচারার দিয়েই বিভাগ পরিচালনাসহ অন্যান্য সকল একাডেমিক/নন একাডেমিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এ সকল কাজে অনভিজ্ঞ লেকচারদের সামর্থ্যরে উপযোগিতা কতটুটু ফলপ্রসু হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক ইউজিসিও সার্বিক বিষয়ের অত্যাধিক চাপে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে নজরদারিতে দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে বাধ্য হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক এক্সিলেন্সির অবনমন ঘটে। 

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এতোগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ প্রভৃতি পদে নিয়োগ দিতে বা বাছাই করতে সরকারকে গলদঘর্ম হতে হয়। উপযুক্ত পদাধিকারী বাছাই করতে সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। ফলে উক্ত পদগুলোতে নিয়োগ দিতে সরকারের ছয় মাস থেকে এক বছরের বেশি, কখনও কখনও তারও বেশি সময় লেগে যায়। এ অবস্থায় চলমান ৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ধরলে তিনটি পদ মিলে ১৫০ জনের অধিক সংখ্যক (কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে একাধিক প্রো-ভিসির পদ) যোগ্য প্রার্থী খুঁজতে গিয়ে অনেক অযোগ্য প্রার্থী পদাশীন হন এবং নানা রকম অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং দলবাজির দৌরাত্ম্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অরাজকতা তৈরি হয়, তা আমরা প্রায়শ পত্রিকার পাতা খুললেই দেখতে পাই। 

আশি-নব্বইয়ের দশকে অল্প কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের যে প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা বা মর্যাদা দেখেছি এবং তাঁদের কর্ম-দক্ষতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গতিশীলতা-সুনাম তৈরি হয়েছে, ধনে-মানে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কীর্তিগাথা এখন তার ছিঁটে ফোঁটাও নেই। তখনকার সম্মানীয় ভিসিদের কর্ম-দক্ষতার সুনাম এতটাই কৌলিন্যপূর্ণ ছিল যে, ভিসিপদের মেয়াদশেষে সরকার তাঁদের দেশের অন্য কোনো উচ্চপদে সসম্মানে আশীন করতেন। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা সীমিত হলে সব দিক দিয়েই দেশের ফলপ্রসু আস্থাশীলতা তৈরি হবে বলে আমি মনে করি।

এবার কলেজ-বিষয়ে আমার অভিমত। কলেজগুলোকে বিভাগীয় শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করে দিতে হবে। আশির বা নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত গোটা দেশের কলেজগুলো তো বড়ো তিনটি বিশ্ববিদ্যালের সঙ্গে যুক্ত ছিলো, তখন কলেজগুলো শিক্ষার গুণগত মানসহ অন্যান্য একাডেমিক/নন একাডেমিক কার্যক্রমে এগিয়ে ছিলো। দেখা গেছে, কোনো কোনো বছরে একাডেমিক ফলাফলে, খেলাধুলায় বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে টেক্কা দিয়েছে। কিন্তু সেটা এখন আর নেই। এখন সময় এসেছে কলেজগুলোকে ঢেলে সাজাবার। এখনও অনেক কলেজ আছে গুণে-মানে, সম্পদে-ভূমিতে অনেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এগিয়ে আছে। কাজেই কলেজগুলোকে নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। কলেজগুলো কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত হলেই হবে না কলেজগুলোকেও হয়ে উঠতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম পর্যায়ের। 

এক্ষেত্রে কলেজশিক্ষকদের গুণগত মান, সুযোগ-সুবিধা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমপর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। এ পর্যায়ের সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা হলো, তাঁদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া। কাজেই আমার প্রস্তাব হলো কলেজশিক্ষকদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া হবে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে, ভিন্নতর প্রক্রিয়ায়। এই প্রক্রিয়াটি হতে পারে ইউজিসির মাধ্যমে বা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। প্রক্রিয়াটি এমন হতে হবে যে, যাতে কেবল শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী মেধাবীরাই আসতে পারবে, যাতে থাকতে হবে কিছু ভিন্নতর যোগ্যতার মাপকাঠি। অনুমান করা যেতে পারে, একটা সময়ে কলেজগুলো এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়ে উঠবে যে, কলেজের শিক্ষকও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে পারবে এবং প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও কলেজে ক্লাস নিবে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে  প্রভাষক পদে সরাসরি কোনো নিয়োগ হবে না। প্রার্থীকে অবশ্যই কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে আসতে হবে। তাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা-সহকারি হিসেবে কাজ করে একাডেমিক দক্ষতা অর্জন করতে হবে অথবা কলেজে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিক্ষকতা করে আসতে হবে। এক্ষেত্রে একাডেমিক দক্ষতা-অর্জনে কিছু সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি থাকবে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে একটা নির্দিষ্ট সময় পার করে দক্ষতা অর্জন করে তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, তাই এখানে এই কথাটি স্পষ্ট যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবশ্যই স্বতন্ত্র পে-স্কেল দিতে হবে। স্বতন্ত্র পে-স্কেল ব্যতিরেকে কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। তা হলে অবশ্যই এই মহান পেশাটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে এবং মেধাবীরা সময় পার করে হলেও এই পেশায় আসতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

এইবার ছাত্র-রাজনীতি নিয়ে কিছু বলতে চাই। বিষয়টি নিয়ে এর আগে অনেক তাত্ত্বিক-বিশেষজ্ঞ নানা দৃষ্টিকোণে পূর্বাপর ঘঠনাবলি বা ইতিহাসের দৃষ্টান্ত দিয়ে ছাত্ররাজনীতির অপ্রয়োজনীয়তা বা অপরিহার্যতা নিয়ে কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, স্বাধীন দেশে ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই। সেটাতো আমরা চোখ খোলা রেখেই স্পষ্ট দেখতে পেলাম। কোনো নির্দিষ্ট দলীয় রাজনীতির ছাত্র-সংগঠনের ব্যানারে না থেকেও ছাত্ররা অসাধ্য সাধন করেছে। কাজেই এ কথা বলতে আর দ্বিধা নেই যে, স্বাধীন বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীর আর অপরিহার্যতা নেই। 

ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি কিছু কলেজ-প্রশাসন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। তবে উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে, সেটি ত্রুটিপূর্ণ । কেননা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাক্ট পরিবর্তন করতে হবে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাক্টে ছাত্ররাজনীতির বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত আছে। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে বুয়েটের মতো ঘটনার সম্ভাবনা থেকে যাবে। বুয়েট-প্রশাসন সছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও জনৈক এক ছাত্রের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট যথারীতি ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে দিয়েছে। কাজেই শিক্ষাঙ্গনের স্বার্থে, দেশের মঙ্গলার্থে ছাত্ররাজনীতি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে।

এক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে অগ্রবর্তী বাংলাদেশের একমাত্র ছাত্ররাজনীতিমুক্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক যাত্রা ৩৪ বছর পেরিয়েছে, কোনো ছাত্ররাজনীতি নেই; রাজনীতির অশুভ বলিতে ঝরেনি কোনো পবিত্র রক্ত, বুকফাটা আহাজারিতে বিদীর্ণ হয়নি কোনো মায়ের কন্ঠ। বছরের ১লা জানুয়ারি এবং ১লা জুলাইতে প্রতিটি সেমিস্টার শুরু হয়; প্রতিটি শিক্ষার্থী ৩১ ডিসেম্বরের আগেই তার একাডেমিক কার্যক্রম শেষ করে চলে যায়। কোনো সেশনজট নেই। ছাত্ররাজনীতি না থাকলেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩১টির মতো সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে; সারা বছর নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে মুখর থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন। তাই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অন্যতম পছন্দের হয়ে উঠেছে খুলনা  বিশ্ববিদ্যালয়, সেটি ছাত্ররাজনীতিমুক্ত হওয়ার কারণেই।

শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-রাজনীতির অপরিহার্যতা না থাকলেও প্রতিটি শিক্ষার্থীকেই রাজনীতি-সচেতন হওয়া অত্যাবশ্যক। কেননা রাজনৈতিক অভিজ্ঞানই যে কোনো নাগরিককে তা সে ছাত্রই হোক বা জনতাই হোক, দেশ-কাল-সমাজ সম্পর্কে নিকটবর্তী করে তোলে, বিশেষত দেশের প্রতি ভালোবাসার অনুভবকে প্রগাঢ় করে তোলে। আর গণতান্ত্রিক সার্বভৌমত্বে যেহেতু রাজনীতি, রাজনৈতিক দল এবং ভোটাধিকার অপরিহার্য, তাই একজন নাগরিককে অবশ্যই রাজনীতি-সচেতন হতেই হয় এবং তার গভীর প্রজ্ঞা থেকেই আত্মস্থ হয় জনস্বার্থ, পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব, সামাজিক বন্ধন, দেশপ্রেম গড়ে ওঠে নেতৃত্ব। কাজেই শিক্ষাঙ্গনগুলোতে থাকবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা সংগঠন, থাকবে খেলাধুলার নানা আয়োজন। আর, এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, এমনকি কলেজগুলোতে থাকতে হবে ছাত্র-সংসদ। আমি মনে করি এই ছাত্র-সংসদের নেতৃত্ব থেকেই বেরিয়ে আসবে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। 

আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করে আমার বক্তব্য শেষ করবো। এটির সঙ্গে যদিও উচ্চশিক্ষা-সম্প্রসারণের কোনো সম্পর্ক নেই, তথাপি আমি মনে করি, এটি হলে উচ্চশিক্ষা আরো প্রতিযোগিতামুলক হবে এবং যুগোপযোগী হয়ে ওঠার প্রেরণা পাবে। আমরা দেখেছি সেই স্বৈরশাসক আইয়ুব খান থেকে আজ অবধি পর্যন্ত বারবার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার বদল হলেও স্বৈরতন্ত্রের বদল হয় না, কারণ বাংলাদেশের শসনতন্ত্রের সঙ্কট সম্পর্কে রাজনৈতিক সরকারগুলোর পূর্বাপর উদাসিনতা। নব্বই-পরবর্তী গত তিন দশক ধরে রাষ্ট্র-পরিচালনায় শাসনতন্ত্র সংস্কারের ধারণায় অনেক নতুন বিষয় যুক্ত হলেও প্রতিটি সরকার শাসন-ক্ষমতা কুক্ষীগত করে রাখার প্রয়োজনে শাসনতন্ত্রে সুশাসনের সঙ্কটের গোড়াতে হাত দিতে চায়নি বা সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। 

এক্ষেত্রে যদিও এটি একটি বড়ো ধরনের বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনচিন্তা। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে সম্ভব কিনা সেটি একটি প্রশ্নও বটে। তবে অসম্ভব মনে হলেও অবাস্তব নয়। অনেকার্থে অসম্ভব বলে বিবেচিত হলেও ছাত্ররা করে দেখিয়েছে, অসম্ভব বলে কিছু নেই। এখন সময় এসেছে এই পরিবর্তনের। সেটি হলো, বাংলাদেশের প্রশাসনিক-বিচারিক ব্যবস্থাসহ সমস্ত কার্যক্রম বিকেন্দ্রিকরণ; এটি সম্ভবপর করে তুলতে বাংলাদেশকে বেশ কয়েকটি, অন্তত ৪টি প্রভিন্স বা প্রদেশে বিভক্ত করতে হবে। 
এরশাদ-সরকার একবার বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করেছিলেন, প্রদেশগুলোর নামকরণও করেছিলেন বিভিন্ন নদীর নামে। উদ্যোগটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সার্বিক পরিকাঠামো-পরিকল্পনা গ্রহণে যথেষ্ট সময় তিনি পাননি এবং পরবর্তীতে দলীয় সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতা বহুবিস্তারী বা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এখনই সময় এসেছে এই ভূমিকা নেওয়ার। 

কেননা কোনো দলীয় সরকার এই ভূমিকা গ্রহণ করবে না। কারণ এতে তাদের ক্ষমতা সংকুচিত হবে, অনেক কিছুই তাদের  হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে; যা দলীয় সরকারের কাছে কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রস্তাবিত এই রূপরেখা বাস্তবায়িত হলে অনেক দিক দিয়ে রাষ্ট্রের বহুমুখী উন্নতি সাধন হবে। সরকারের স্বৈরাচারী ক্ষমতার অবসান হবে, প্রকৃত ও জবাবদিহিতামুলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল দিক দিয়ে প্রদেশগুলোর মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার মানসিকতা তৈরি হবে এবং সর্বোপরি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে উন্নতির চরম সোপানে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হলো, রাজধানী ঢাকার ওপর থেকে সর্বস্তরের চাপ কমে যাবে এবং ঢাকা-বসবাসের বহুমুখী অযোগ্যতার অপবাদের নাম বেশ কিছুটা লাঘব হবে।

আমাদের প্রত্যাশা বহুমুখী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও উপদেষ্টা-মন্ডলীর ওপর দেশবাসীর আকাক্সক্ষা পর্বতপ্রমাণ। আমরা চাই না বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনে শহিদদের আত্মদান বৃথা যাক। উপদেষ্টামণ্ডলীর বিগত কর্মজীবনের প্রায়োগিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সামর্থ্য  রাষ্ট্রের ভিতরে-বাহিরে যাবতীয় আবর্জনা-জঞ্জাল দূর করে একটি সুখী-সুন্দর বাসযোগ্য বাংলাদেশ নির্মাণে সহায়ক হবেন এটাই আমাদের একান্ত চাওয়া।

লেখক: ড. শেখ রজিকুল ইসলাম
প্রফেসর, বাংলা ডিসিপ্লিন
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা
মোবাইল: ০১৭১৬৫৭৫২১৮
e-mail: [email protected]