বৃহস্পতিবার,

২১ নভেম্বর ২০২৪

|

অগ্রাহায়ণ ৬ ১৪৩১

XFilesBd

শিরোনাম

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু শনিবার উজানের দেশগুলোর কাছে বন্যা পূর্বাভাসের তথ্য চাওয়া হবে : পানি সম্পদ উপদেষ্টা নোয়াখালীতে পানি কমছে, ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টে রিট দেশের ১২ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে অপসারণ শেখ হাসিনা মেনন ইনুসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হত্যাকান্ড, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিচার হবে নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও করে না : প্রধানমন্ত্রী সাবেক আইজিপি বেনজীরের সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ আদালতের হবিগঞ্জের কার ও ট্রাকের সংঘর্ষে নারীসহ নিহত ৫ যুদ্ধ ব্যয়ের অর্থ জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবহার হলে বিশ্ব রক্ষা পেত: প্রধানমন্ত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী প্রাণি ও মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর বিএনপি নেতারা সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দেওয়ার অপচেষ্টা করছে : ওবায়দুল

পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে ঢাকার রেসকোর্স: প্রসঙ্গ ১০ জানুয়ারি ১৯৭২

ড. অখিল পোদ্দার

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১১ জানুয়ারি ২০২৪

পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে ঢাকার রেসকোর্স: প্রসঙ্গ ১০ জানুয়ারি ১৯৭২

দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি; করাচির আলোচিত জনসভাস্থল নিস্তার পার্কে জনতার উদ্দেশ্যে কথা বলেন পাকিস্তানের নতুন শাসক প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। উপস্থিত জনতার উদ্দেশে ঐদিন বিকেলে তিনি বলেন- ‘২৭ শে ডিসেম্বর শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। তাঁর প্রশ্ন ছিল, আমি মুক্ত কি না? জবাবে আমি বলেছি-‘আপনি স্বাধীন।’ তারপরও আপনি যদি আমাকে কিছুটা সময় দেন তাহলে আমার জনগণের মতামত যাচাই করতে চাই। তাদের মত-অভিমত ছাড়া আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। কেউ কেউ আমাকে বলেছেন- শেখ মুজিবুর রহমান তুরুপের তাস। সুবিধা আদায়ের জন্য আমি তাঁকে ব্যবহার করতে পারি। অন্যরা বলেন, সুবিধা আদায়ের জন্য আমরা কেনো তাঁকে ব্যবহার করবো? আমিও একমত যে, মুজিবকে ব্যবহার করা ঠিক হবে না। তাঁকে ব্যবহার করে লাভজনক কিছু করতে চাই না আমি। আমার এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে আপনারা একমত কি-না?

জুলফিকার আলী ভুট্টোর এ প্রস্তাবে নিস্তার পার্কে উপস্থিত জনতা বিপুল সমর্থন জানিয়ে মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তিদানের সম্মতি জানান। দি গার্ডিয়ান পত্রিকা ভুট্টোর এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয় লেখে। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়-‘শেখ মুজিবই বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর বিস্ময়কর বাগ্মিতা ও স্বকীয় ভঙ্গির কারণে বাঙালির অসন্তোষকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে পরিণত করেন। তাঁর বক্তৃতায় পূর্বপাকিস্তানের জনগণ ভবিষ্যতে সুদিনের আলো দেখার ভরসা পায়। তাঁকে যদি হত্যা করা হতো কিংবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি রাখা হতো তাহলে বাংলাদেশ সরকার অতি অল্পদিনের মধ্যে মারাত্মক নেতৃত্ব সঙ্কটে পড়তো। সুতরাং শেখ মুজিবের মুক্তি বাংলাদেশকে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। 

ফিরে দেখার তথ্য বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশে ফেরার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর। অতপর ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁকে ঘিরে নানান ঘটনার আবর্তে ঘুরপাক খায় বিশ্বরাজনীতি। জেড এ ভুট্টোর প্রশাসন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল তাঁর বাংলাদেশ যাত্রা। যদিও ভুট্টো আগে থেকেই মুজিবের ব্যাপারে বিশেষ নমনীয় ছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে পাকিস্তানের নিস্তার পার্কে ভুট্টোর জনসভার কথা বলা যেতেই পারে। 

৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডন আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। খবরটি তাৎক্ষণিক শুনে অনেকেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। ব্যাপারটি কিভাবে সম্ভব? এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল শ্রোতাতের মস্তিষ্কে। বিবিসির এ খবর মুহূর্তেই চাউর হয়ে পড়ে। তাই হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তথা মেট্রোপলিটন পুলিশের তখনকার সদরদফতর থেকে পিটার ল্যাংলি টেলিফোন করে প্রবাসী বাঙালিদের কাছে বিশেষ খবরটি পৌঁছে দেন। লন্ডনে বাঙালিদের নেতৃত্বদানকারী স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহŸায়ক শেখ আব্দুল মান্নানকে শেখ মুজিবের আগমনের সংবাদটি জানিয়ে দেন পুলিশ অফিসার পিটার ল্যাংলি। যদিও মিস্টার ল্যাংলি স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আর এভাবেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ২২ দিন পর মুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় বীরের বেশে লন্ডনে পৌঁছেছিলেন।             
১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার আপা বি পন্থ তাঁকে স্বাগত জানান। যেখানে উপস্থিত ছিলেন শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জী। তাঁকে আগে থেকেই চিনতেন শেখ মুজিব। আবেগ আপ্লুত হয়ে বললেন ‘ব্যানার্জী, এখানেও আছেন!’ পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন ইয়ান সাদারল্যান্ড। আর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মুজিবের যোগাযোগ করিয়ে দেন আপা বি পন্থ। এমনকি তাঁর মাধ্যমেই শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনে বসে টেলিফোনে ৩০ মিনিটের মতো কথাও বলেন শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানিয়ে নিমন্ত্রণও করেন। ইন্দিরার আমন্ত্রণ রক্ষা আর ভারতের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই ঢাকায় ফেরার পথে পালাম বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেন শেখ মুজিব।

এদিন অর্থাৎ ১০ জানুয়ারি লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করে। যেখানে উল্লেখ করা হয়- শেখ মুজিবের মুক্তিলাভ প্রধান ও সর্বোত্তম ব্যাপার। ফলে বাংলাদেশের টিকে থাকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর মাটিতে তাঁর পা রাখামাত্রই এই নতুন রাষ্ট্র একটি বাস্তব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘ সময় জেলে কাটানোর পর দূরবর্তী ভ্রমণে শারীরিক সমস্যা যাতে না ঘটে সেজন্য পথিমধ্যে যাত্রাবিরতি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল লন্ডন থেকেই। সাইপ্রাসের পর ওমান হতে কমেট বিমান যখন আকাশে উড়লো তখন দাঁড়িয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু। গাইতে শুরু করলেন-আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর চোখ ভিজে গেলো। শশাঙ্ক ব্যানার্জি বললেন, আপনি কাঁদছেন। অবিসংবাদিত নেতা বললেন, ব্যানার্জি ধরে ফেলেছেন। কিছুক্ষণ বাদে আবারও গানটি গাওয়া শুরু করলেন তিনি। বললেন-এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। কেমন হবে বলেন তো ব্যানার্জি? কুটনীতিক শশাঙ্ক উত্তরে বললেন-আপনি নেতা, যা ঠিক করবেন তাই হবে। তবে এটি হলে আপনি একটি ইতিহাসও গড়বেন। কেনো না এই উপমহাদেশের তিনটি দেশ-ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাহলে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যাবেন।  কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু বললেন-ব্যানার্জি একটি সহযোগিতা চাই। ছ’মাস নয়, আমি চায় তিন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ফিরে যাক। শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগেই খবরটি তাঁর কানে দেয়া দরকার। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চলে গেলে ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি পেতে আমার কোনো বাধা থাকবে না। এ ব্যপারে এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গেও কথা হয়েছে।  দিল্লিতে নেমে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি ইন্দিরা গান্ধীকে ব্যাপারটি জানান। শ্রীমতি গান্ধী বললেন, আমি শেখ মুজিবের মুখ থেকেই দাবিটি শুনতে চাই। 

দিল্লির আরেকটি ঘটনা বেশ উল্লেখযোগ্য। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করলেন দেশটির সরকারি বিমানে ঢাকায় ফিরতে। এমনকি রূপালি কমেট থেকে মালামাল যথাদ্রুত ভারতের সরকারি বিমান রাজহংসে স্থানান্তরও করা হয়। হঠাৎ করেই তাতে বাদ সাধেন শেখ মুজিব। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। উপরন্তু তিনি বললেন, বিশেষ সৌজন্যের বশে ব্রিটিশ সরকার যে বিমানটি দিয়েছে মাঝপথে তা বদলে ফেলা সমীচীন হবে না। এমনকি বিমান পরিবর্তনের ব্যাপারটি ততোক্ষণে ঢাকার ধানমন্ডিতেও পৌঁছে গেছে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা শোনার পর মুজিবকে বারণ করেছিলেন বিমান বদলের। তাজউদ্দীন আহমদ দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, মাঝখানে বিমান বদলে ফেললে ব্রিটেনের সরকার ও জনগন মন:ক্ষুন্ন হতে পারে। ব্রিটিশ বিমানে তাই দেশে ফেরার পরামর্শ দেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।   

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক ভবন থেকে সম্প্রচার হতো ঢাকা টিভি; ১০ কিলোমিটারের বাইরে তা দেখার সুযোগ ছিল না। সুতরাং খবরাখবর জানার একমাত্র মাধ্যম তখন রেডিও। সংবাদ শুনতে সাধারণ মানুষ ছুটতেন অন্যের বাড়িতে কিংবা বিভিন্ন দোকানে। তখন বেশিরভাগ দোকানে রেডিও মিলতো। 

যদিও শেখ মুজিবের জন্য দেশে ফেরার সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল ভারত হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছানো। কিন্তু দুরদর্শী নেতা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ভারত হয়ে ফিরলে দুর্জনেরা ঘটনাটির অপব্যাখ্যা দিতে পারে। সুতরাং ভারত ব্যতিরেকে লন্ডন হয়ে দেশে ফেরাটাই সমীচীন মনে করেন অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। পাকিস্তান তো বটেই, শক্রুপক্ষ যাতে বলতে না পারে যেÑশেখ মুজিব ভারতের বশংবদ ও আজ্ঞাবহ। তাই আধুনিক গণতন্ত্রের সুতিকাগার হিসেবে পরিচিত লন্ডন হয়ে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। শুধু যে লন্ডনেই রাজকীয় সম্মান দেয়া হয় তা কিন্তু নয়। দিল্লির বিমানঘাঁটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানি, ভুটান, বুলগেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চেকো¯েøাভাকিয়াসহ আরও ক’টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সবার সামনে শেখ মুজিবকে তুলে ধরা হয় অনন্য এক উচ্চ আসনে। 

অবতরণের পূর্বে কমেট বিমান কিছুক্ষণ আকাশে উড়েছিল। যদিও সেটি বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছেয়। প্রায় ৪৫ মিনিট চক্রাকারে ঘুরতে থাকে বিমানটি। নিচে তখন লাখো মানুষের হর্ষধ্বনি। কেউ কেউ আবেগে কেঁদেও উঠলেন। ওপর থেকে তখন সোনার বাংলাকে গভীরভাবে দেখছেন বাঙালি জাতির জনক। 

দুপুর পৌনে দুটো নাগাদ তেজগাঁওয়ের মাটি স্পর্শ করলো ব্রিটিশ কমেট। অতপর দৃশ্যমান হলেন পিতা। তিনি দাঁড়ালেন বিমানের সিঁড়িতে। হাত নেড়ে অভিবাদন জানান উপস্থিত জনতাকে। প্রিন্স কোটে মোড়ানো ঋজু দেহ। ঔজ্জ্বল্য ছড়ানো মুখচ্ছবিতে কিছুটা ক্লান্তির রেশ।  বিমানে সিঁড়ি লাগানোর পর পরই এগিয়ে যান ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুজিববাহিনীর প্রধান, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবৃন্দ। ছিলেন মিত্রবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাগণ। মানুষের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে অল্প সময়ের মধ্যেই উবে যায় সব ধরণের প্রটোকল। মুহূর্তেই হাজারো জনতা বিমানটিকে ঘিরে ব্যুহ বানিয়ে ফেলেন। অবিস্মরণীয় সে মুহূর্ত, অভূতপূর্ব সে মাহেন্দ্রক্ষণ। স্বজন হারানোর বেদনা আর আবেগে হুহু করে কেঁদে ওঠেন বীরবাঙালি। অশ্রুভারাক্রান্ত মুজিবের চোখ তখন টলটলায়মান নদী। জ্যেতির্ময় অবয়বে বেদনার প্রচ্ছায়া। ততোক্ষণে একত্রিশবার তোপধ্বনিতে কম্পিত তেজগাঁও বিমানবন্দর। পুষ্পবৃষ্টিতে স্নাত শেখ মুজিব এতো মানুষের আকুতি দেখে আর স্থির থাকতে পারলেন না। শিশুর মতো ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বুকে জড়িয়ে নিলেন প্রিয় যোদ্ধাদের। জনতার মহাসমূদ্র উতরে বঙ্গবন্ধু অতপর সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর গার্ড অফ অনার গ্রহণ করেন। পাশে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্ণেল আতাউল গনি ওসমানী, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল শফিউল্লাহ ও জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ পুত্র লেফটেন্যান্ট শেখ কামাল। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়াও সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার ও অন্যান্য দেশের কুটনীতিকরা তাঁকে সংবর্ধনা জানান।

সাধারণ মানুষের মতোই বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এসেছিলেন বিমানবন্দরে। সঙ্গে ছিলেন ছোট ছেলে শেখ রাসেল। লাখো জনতার ভিঁড়ে মায়ের হাত ধরে বাবাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। জনসমূদ্র উতরে কাছ থেকে বেগম মুজিব দেখতে পেলেন না জাতির জনককে। বেশ কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করে নিরবে ফিরে যান নিভৃতচারী অতিবিচক্ষণ বেগম মুজিব। ততোক্ষণে খোলা জিপে চেপে বসেছেন জনতার নেতা।  গন্তব্য যাঁর রেসকোর্স ময়দান। জিপের পিছে পিছে অগ্রসর হতে থাকেন মুক্তিকামী উন্মাতাল বাঙালি। একদিকে স্বাধীনতার আনন্দ, অন্যদিকে স্বজন হারানোর বিধুর ব্যথা। এতো দিন পর মুক্তির মহানায়ককে কাছে পেয়ে আবেগে উদ্বেলিত সবাই। সজল চোখে প্রত্যেকেই ব্যস্ত মহানায়কের বরণে। প্রতিটি মানুষের চোখেমুখে ভিন্ন এক উত্তেজনা। বহু প্রতীক্ষার পর প্রিয় নেতাকে কাছে পেয়েছেন। কারাগারের শৃঙ্খল ছিঁড়ে দেশের মাটি ছুঁয়েছেন তিনি। দ্যুতিময় চেহারা যেনো ঝিলিক ধরিয়ে দেয় সবার মধ্যে। কবি নির্মলেন্দু যেভাবে বলেছেন- ‘অমনি পলকে দারুণ ঝলকে হৃদয়ে লাগিল দোলা/ জনসমূদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা।’ রেসকোর্স ময়দানে যেতে যেতে বাঙালির মুজিব বরণ করলেন প্রিয় স্বদেশকে। বুক ভরা নিশ্বাসে মেখে নিলেন সোঁদা মাটি আর সুফলা বাংলার চিরায়ত ঘ্রাণ।    

তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ক্রমশ এগিয়ে চলে বঙ্গবন্ধুর বহনকারী ট্রাক। সঙ্গী হিসেবে আছেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ। অবিসংবাদিত নেতার সান্নিধ্য পেতে কেউ কেউ ট্রাকের কোণা ধরে ঝুলতে থাকেন। রেসকোর্সে তখন লাখো মানুষের প্রতীক্ষা। সবাই কাছ থেকে দেখতে চান প্রাণের নেতা শেখ মুজিবকে। শুনতে চান, জেল-জুলুম আর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী। যাঁর ভাষণকে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র মেনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি ফিরেছেন স্বাধীন দেশে, বিজয়ীর বেশে। আর যে মাঠে সবাই জড়ো হয়েছেন-সেখানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির মুক্তির অমোঘ বাণী শুনিয়েছিলেন। 

দুপুর গড়িয়ে বিকেল তখন অত্যাসন্ন। শীতের জড়তা উপেক্ষা করে রেসকোর্সের বিশাল ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর বহনকারী সুদৃশ্য ট্রাকটি ততোক্ষণে পৌঁছে গেছে রমনার কাছাকাছি। রাস্তার দু’পাশে সুদৃশ্য তোরণ। মৃদু বাতাসে দোলায়মান বাংলাদেশের পতাকা। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো রাজপথ। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি মানুষ। তেজগাঁও থেকে জনসমূদ্রের সে ঢেউ এসে মিশেছে রমনার রেসকোর্সে। এতো এতো মানুষের হৈ হুল্লোর, করতালি, মুহূর্মুহু শ্লোগান উতরে দু’ঘন্টা তেরো মিনিট পর মুক্তির মহানায়ক পৌঁছালেন রেসকোর্সে। ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে চারটে। অপেক্ষমান জনতার হৈ চৈ তৎক্ষণাৎ বেড়ে গেলো বহুগুণ। বন্দি খাঁচার মুক্ত পাখিরা যেমন সমস্বরে ডাক তোলে-তেমনি। আবাল বৃদ্ধ বনিতার সে কী উল্লাস! আনন্দধ্বনিতে মুখর পুরো এলাকা। মিষ্টিমুখর সে হর্ষধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে কানে কানে। আস্তে ধীরে এগিয়ে অবশেষে মঞ্চে থিতু হলেন স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে আবারও প্রকম্পিত হলো রেসকোর্স। চতুর্দিক থেকে বাণের জলের মতো উপচে পড়ছে মানুষ। আবারও পুষ্পবৃষ্টিতে অভিনন্দিত হন বাঙালির প্রাণের নেতা। আনন্দে কেঁদে ফেলেন উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা কিংবা সাধারণ জনতার কেউ কেউ। স্টেশনের কুলি থেকে ঘাটের পাটনি পর্যন্ত ছুটে এসেছেন শেখ মুজিবকে দেখতে। গেরস্থালির কাজ ফেলে রেসকোর্স এসেছেন ব্যস্ত বধু আর বৃদ্ধ-বণিতা। রমনার বাতাসে ধ্বনি ওঠে‘বিশ্বে এলো নতুন দেশ, বাংলাদেশ-বাংলাদেশ। বিশ্বে এলো নতুন বাদ, মুজিববাদ-মুজিববাদ।’

 শ্লোগানের সময় অনেকেই নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে চলে আসেন বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি। প্রোটোকল ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল নিরাপত্তাকর্মীদের জন্যে। সবাই স্পর্শ করতে চান শেখ মুজিবকে। এতো মানুষের আকুতি আর ভালোবাসা দেখে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কোন ধরণের ভাষা ব্যবহার করে প্রতিদানের বাক্য গঠন করবেন ঐ পরিবেশে তা যেনো ভুলেই গিয়েছিলেন স্বাধীনতার অমর কবি শেখ মুজিব। দু’চোখ বেয়ে অঝর ধারায় জল ঝরছে তাঁর। না খাওয়া-না পাওয়া, শোষিত-নির্যাতিত লাখ লাখ বাঙালির কী নিরঙ্কুশ-নির্মোহ ভালোবাসা! রুমালে আবারও চোখ মুছলেন তিনি। 

অবিসংবাদিত নেতার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট লিখলো-‘অ্যারাইভড এ্যাট ঢাকা এয়ারপোর্ট অন ১.৪৫ অ্যাবোর্ড আ ব্রিটিশ রয্যাল এয়ারফোর্স কমেট। হি ফ্লিউ ফ্রম নিউ দিল্লি হোয়ার মিট উইথ প্রাইম মিনিস্টার ইন্দিরা গান্ধী এ্যান্ড প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি অন হিজ ওয়ে হোম ফ্রম লন্ডন।’ 

১১ জানুয়ারি লন্ডনের টাইমস পত্রিকার এডিটরিয়ালের মন্তব্য ছিল এমন ‘বাস্তব সত্য হচ্ছে শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর পূর্ব পাকিস্তানের বিলুপ্তি ঘটেছে এবং পূর্ব-বাংলা বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে।’ নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়Ñ‘বিমানবন্দর থেকে শেখ মুজিব যখন ধীরে ধীরে জনতার দিকে এগোচ্ছিলেন তখন জনতা তাঁর ওপর ফুলের পাঁপড়ি বর্ষণ করছিল। তারা তালে তালে শেখ মুজিব জিন্দাবাদ শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চলেছিল।’ ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রতিবেদনটি ছিল এমন ঢাকায় অসংখ্যা জনতা তাঁকে এক বিজয়ী বীরের সম্বর্ধনা দেয়। তিনি বিমানবন্দর থেকে সোজা রেসকোর্সের সুবিশাল জনসভায় পৌঁছান।

(লেখক: ড. অখিল পোদ্দার: প্রধান বার্তা সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন)