আমাদের অভিভাবকহীন করে চলে গেলেন তিনি। আর কোনো দিন কথা হবে না। ফোন করে আর জিজ্ঞেস করবেন না, ‘দেশের খবর কী? ষড়যন্ত্রকারীরা কি এখনো তৎপর? সরকার সব কিছু সামাল দিতে পারছে তো?’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আমাদের গাফ্ফার ভাই আজ কফিনবন্দি হয়ে দেশে ফিরছেন। শহীদ মিনারে নেওয়া হবে তাঁকে।
তাঁর প্রিয় বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তাঁর জানাজা হবে। নেওয়া হবে তাঁর প্রিয় জাতীয় প্রেস ক্লাবে। কোথাও সেই প্রাণময় গাফ্ফার ভাইকে পাওয়া যাবে না। হাসিমুখে জানতে চাইবেন না, ‘খবর আছে কিছু’।
তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয় ঠিক কবে হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। অন্য সবার মতো আমিও জানতাম তিনি একুশের অমর গানের রচয়িতা, সাংবাদিক, কলামিস্ট। কিন্তু তিনি যে একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, সেটা জেনেছি অনেক পরে। মুগ্ধ হয়ে পড়েছি তাঁর গল্পগ্রন্থ সম্রাটের ছবি।
কলাম পড়তে গিয়েও পেয়েছি এক অসাধারণ গল্প-কথককে, যিনি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর মতের সঙ্গে যাঁরা মোটেও একমত পোষণ করেন না তাঁরাও তাঁর কলামের মুগ্ধ পাঠক ছিলেন। ভাগ্য আমাকে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়ে আসে। এখানে আমার শুরুটাও হয় সম্পাদকীয় বিভাগে। নতুন ঝাঁ-চকচকে কাগজ বেরিয়েছে তখন, জনকণ্ঠ।
সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন ভাই, এ টি এম শামসুদ্দিন। শুভ ভাই, পাশা ভাই আছেন। সবার মাথার ওপরে তোয়াব ভাই, তোয়াব খান। জনকণ্ঠেই পরিচয়, মূসা ভাই, ওয়াহিদ ভাই—দিকপাল সব সাংবাদিকের সঙ্গে। গাফ্ফার ভাই লেখেন অন্য কাগজে। জনকণ্ঠে তখনো লেখা শুরু করেননি। এই জনকণ্ঠেই গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়।
তোয়াব ভাই সকালে অফিসে আসতেন। ঠিক দুপুর ১টায় বেরিয়ে যেতেন। আবার সন্ধ্যা ৬টায় ঢুকতেন অফিসে। বের হতেন কাজ শেষ করে। আমি ছিলাম তাঁর আশ্রয়ে। প্রশ্রয়টাও পেতাম একটু বেশি। তোয়াব ভাই অফিসে না থাকলে তাঁর ফোনগুলো আমি রিসিভ করতাম। একদিন দুপুরে আমাদের টেলিফোন অপারেটর জানালেন, লন্ডন থেকে ফোন এসেছে। আমি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বললেন, আমি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলছি, তোয়াব কোথায়। আমি সালাম দিয়ে বললাম, তোয়াব ভাই এ সময়ে বাসায় থাকেন।
গাফ্ফার ভাই বললেন, তিনি জনকণ্ঠে একটি লেখা পাঠাতে চান। কোনো পরিবর্তন ছাড়া লেখাটি ছাপতে হবে। জনকণ্ঠ ছাপবে কি না। তোয়াব ভাই এলে আমি যেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিই। আমি বললাম লেখা পাঠিয়ে দিন। তখন ইন্টারনেট ছিল না। ছিল ফ্যাক্স। ফ্যাক্স নম্বর দিলাম, সঙ্গে তোয়াব ভাইয়ের বাসার নম্বরটিও। তাঁর নম্বরটি নিয়ে রাখলাম। তিনি লেখা পাঠিয়ে আবার খোঁজ নিলেন, ঠিকমতো পড়া যাচ্ছে কি না।
সন্ধ্যায় তোয়াব ভাই আসা মাত্র তাঁকে বললাম গাফ্ফার ভাইয়ের কথা। জানালেন, বাসায় ফোন করেছিলেন গাফ্ফার ভাই। ওই সেদিন থেকেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের শুরু। বয়সে তিনি আমার বাবারও দুই বছরের বড়। কিন্তু বয়সের ব্যবধান ঘুচিয়ে তিনি আমার ভাই হয়ে গেলেন। বন্ধু হয়ে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যেই আমার ও আমার পরিবারের অভিভাবক হয়ে গেলেন তিনি।
কালের কণ্ঠে প্রথম সংখ্যা থেকেই লিখছেন গাফ্ফার ভাই। প্রথম দিনের বিশেষ আয়োজনে জানিয়েছিলেন কালের কণ্ঠের কাছে তাঁর প্রত্যাশার কথা। লিখেছিলেন, ‘...বাজারি পত্রিকায় লোভের ও লাভের বাণিজ্যযাত্রায় শামিল হবে না। শামিল হবে গণমানুষের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার লড়াকু মিছিলে। সে দ্বিরাচারী, অসৎ নিরপেক্ষ পত্রিকা হবে না। হবে সৎ ও শুভ শক্তির পক্ষের পত্রিকা। তার যুদ্ধ হবে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, হিংস্র মৌলবাদ, বিশ্বায়নের দৈত্য, অবাধ লুণ্ঠনের মুক্ত বাজার ও নব্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।
...এই কণ্টকাকীর্ণ সাংবাদিকতার পথে কালের কণ্ঠ যদি যাত্রা শুরু করতে পারে, তাহলে আজকের কুৎসা ও কলঙ্কই হবে তার ভবিষ্যতের গর্ব ও ভূষণ। এই রুদ্ধকণ্ঠ, সংগীতহারা বাঁশির ভুবনে কালের কণ্ঠ স্বকালের সব বৈরিতা অতিক্রম করে দ্রোহের আগুন জ্বালাতে পারবে। অগ্নিশুদ্ধ ভবিষ্যতের পথ রচনা করতে পারবে। ...কালের কণ্ঠ নামের পত্রিকাটির কাছ থেকে এই বিপ্লবী ভূমিকা আমি আশা করি না। একটি সৎ ও সাহসী ভূমিকা আশা করি। সে নিজে সুস্থ থাকবে এবং দেশে সুস্থ জনমত তৈরি করবে—এটাই আমার শেষ বয়সের আশা।’
গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ২০০৭ সালের মার্চ মাসে। তখন বাংলার মসনদে ‘চেপে বসা সরকার’। গাফ্ফার ভাই এসেছেন ঢাকায়। সন্ধ্যার পর দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাকে ডেকে পাশে বসালেন। আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেই আশীর্বাদের হাত আমার মাথায় ছিল। ছায়া হয়ে তিনি আমাকে আগলে রেখেছেন। আমার ব্যক্তিগত সংকটে তিনি বিচলিত হয়েছেন। গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত এমনই ব্যক্তিগত পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে আমরা পরস্পরের সঙ্গে অভিমান করতে পারতাম। গাফ্ফার ভাইয়ের ভাষাতেই বলি, ‘মতান্তর হয়েছে, মনান্তর হয়নি কখনো।’
লেখাকে দায়িত্ব মনে করতেন তিনি। বলতেন এটাই তাঁর ব্রত-সাধনা। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিয়ম করে লিখতে বসতেন। সব সময় হাতে লিখেছেন। লেখা শেষ হলে আগে ফ্যাক্স করতেন। পরে পিডিএফ কপি পাঠাতেন মেইলে। গত বছর অসুস্থ হওয়ার পর ডিকটেশন দিতেন। যিনি ডিকটেশন নিতেন, তিনি কম্পোজ করে পাঠানোর পর সেটা নিজের হাতে সংশোধন করে পিডিএফ করে পাঠাতেন।
কত যে স্মৃতি গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে। কোন বিষয়টি নিয়ে কথা হয়নি বলা মুশকিল। লেখার বিষয় নিয়ে কথা হতো। নিয়মিত ক্লিপিং পাঠাতে হতো। ফোন করলেই প্রথম প্রশ্ন দেশের খবর কী? সরকারের বিরুদ্ধে কি কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে? এরপর অসুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। চিকিৎসক কথা বলতে নিষেধ করেছিলেন। ডাক্তার-নার্সদের চোখ এড়িয়ে ফোন করতেন তিনি। হাসপাতালে তাঁর ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না। সরাসরি ফোন করে বসতেন। প্রথম প্রশ্নই ছিল, দেশের খবর কী? তাঁর মেয়ে চিন্ময়ী চৌধুরী, যাঁকে আমরা চিনু বলে জানি, তিনি হাসপাতালে গেলে তাঁর ফোন থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিতেন। ১৭ মে মঙ্গলবার রাতে ফোন করে যথারীতি জানতে চাইলেন দেশের খবর। ১৯ মে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় দুপুরে জানলাম, তিনি অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন।
লেখক : সাংবাদিক
[email protected]