আজ বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের এক সাহিত্য মনা পরিবারে ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ সালের জন্মগ্রহণ করেন। ফয়জুর রহমান-আয়েশা ফয়েজ দম্পতির প্রথম সন্তান ছিলেন তিনি।
তাই বাবা-মায়ের খুব প্রিয় ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। জন্মের আগে তার বাবার ধারণা ছিল তাদের প্রথম সন্তান মেয়ে হবে। বাবা তো বড় মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছিলেন, ফ্রক বানিয়ে রেখেছিলেন৷ কিন্তু, মেয়ে না হয়ে ফয়জুর রহমান-আয়েশা ফয়েজের ঘরে জন্ম নেয় ছেলে সন্তান। এ জন্য অবশ্য দীর্ঘদিন তাকে মেয়েদের মতো সাজানো হতো। মা আয়েশা তার লম্বা চুলে মেয়েদের মতো বেণি করে দিতেন।
ছেলেবেলা বাবা ফয়জুর রহমানের সঙ্গে নামের মিলে রেখে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান। এ ছাড়া, তার ডাকনাম ছিল কাজল। তখন তাকে সবাই কাজল নামেই চিনত এবং এই নামেই ডাকত। তার বাবা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন। রেজাল্ট প্রকাশের পর দেখা গেল তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছেন৷ এরপর ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন৷ সেখানেও মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন৷ এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে৷ ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন এবং একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করেন।
সাহিত্যিক হলেও চলচ্চিত্র নির্মাণে দারুণ সফল ছিলেন তিনি । তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র 'আগুনের পরশমনি'৷ এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। হুমায়ূনের প্রথম চলচ্চিত্রটি ৮টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। এ ছাড়া তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র— শঙ্খনীল কারাগার, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, নন্দিত নরকে, প্রিয়তমেষু, দারুচিনি দ্বীপ, আমার আছে জল, ঘেটুপুত্র কমলা ইত্যাদি। এর মধ্যে শ্যামল ছায়া ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। এটি অস্কারে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছিল।
নাট্যকার হিসেবেও তিনি ছিলেন চরম জনপ্রিয় । এই সব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবার, সবুজ সাথী, উড়ে যায় বকপক্ষী, এই মেঘ এই রৌদ্র, কালা কইতর, চন্দ্র কারিগর এরকম অসংখ্য নাটক দর্শকের মন ছুয়েছে।
১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' প্রকাশিত হয়। প্রথম বই দিয়েই আলোচনায় আসেন তিনি। সেই যে শুরু, তা চলেছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এই সময়ে দুই শতাধিক উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি।
হুমায়ূন আহমেদের গদ্যে বরাবরই মধ্যবিত্তের জীবনের গল্প উঠে এসেছে। এ জন্য হয়তো তার লেখা এত পাঠকপ্রিয় হয়েছিল। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো আলোড়িত করেছিল পাঠককে।
হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে আছে- মিসির আলী, হিমু, শুভ্র ইত্যাদি। এরমধ্যে মিসির আলী সবসময় লজিক নিয়ে কাজ করে। অন্যদিকে হিমু তার বিপরীত। হিমু সবসময় এন্টি লজিক নিয়ে কাজ করে৷ হিমু চরিত্রকে তরুণ পাঠকের মগজে ও মননে গেঁথে দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু ভক্তরা তো হলুদ পাঞ্জাবী পরে খালি পায়ে বইমেলাতেই চলে আসতেন। এখনো হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন কিংবা প্রয়াণ দিনে হলুদ পাঞ্জাবী পরে তাকে শ্রদ্ধা জানান।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে ক্যান্সারে চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নন্দিত এই কথাসাহিত্যিককে তারই প্রিয় গাজীপুরে নুহাশপল্লীর লিচুতলায় চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
তার লেখার মাধ্যমে ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য বা রাজনীতির বিষয়ে আমাদের গভীর উপলব্ধি বা সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরতে, সৃষ্টি করেছেন হিমু, মিসির আলী, শুভ্র বা বাকের ভাইয়ের মতো চরিত্র। এরকম অসংখ্য গল্প-উপন্যাস বা নাটকের চরিত্র হয়ে শতকোটি বছর বেঁচে থাকবেন ভক্ত হৃদয়ে।