তোয়াব খানের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, সারা জীবন গল্প করার মতো অনেক সঞ্চয় তাদের আছে। এর একটি হলো মিটিং! জনকন্ঠে প্রতিদিন রিপোর্টিং মিটিং হতো। রিপোর্টিং মিটিং এরপর হতো সম্পাদকীয় বিভাগের মিটিং। তোয়াব খানের মিটিং মানে যেন ছিল কাঠগড়া! তোয়াব খান, একুশে পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশের অন্যতম মহীরুহ সাংবাদিক মানে আমাদের তোয়াব ভাই। মিডিয়ায় ‘ভাই’ সম্বোধন বিশেষ প্রচলিত।
পত্রিকা যদি সেদিন কোন কিছু মিস করে থাকলে বা রিপোর্ট জনকন্ঠেরটা ভালো না হলে যেন আগুন ঝরতো সেই মিটিঙে! শুধু ঢাকায় রিপোর্ট নয়। ঢাকার বাইরে এমন কি দেশের বাইরে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, নিউইয়র্কের মতো শহরেও আলোচিত বিশেষ কোন কিছু মিস করে থাকলে ফোনে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারকে জবাবদিহি করানো হতো। বকাঝকার পালা শেষে ফলোআপ রিপোর্ট কিভাবে ভালো করা যায় দেয়া হতো সে দিক নির্দেশনা। এভাবে রিপোর্টিং মিটিঙে বা ফোনে তোয়াব খানে কাঠগড়ায় জবাবদিহির সম্মুখিন হননি, তাঁর নেতৃত্বের পত্রিকায় এমন কেউ ছিলেন না।
জনকন্ঠের মিটিং, তোয়াব খানের মিটিং এক সময় ঢাকার মিডিয়ায় বিশেষ আলোচিত প্রসঙ্গও ছিল। কারন রিপোর্টারদের বলা হয় আলস্য মহাশয়! রিপোর্টার দেরিতে ঘুমুতে যান। দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন। তাই প্রতিদিন রিপোর্টিং অপ্রয়োজনীয় কী না তা নিয়ে মিডিয়া পাড়ায় আলোচনা হতো।
কিন্তু মিটিং এবং তোয়াব খান যেন ছিল হরিহর আত্মা! দু’জনে দু’জনার। জীবনের বিভিন্ন সময়ে সরকারি কর্মকর্তাও ছিলেন সাংবাদিক তোয়াব খান। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব থেকে শুরু করে মিডিয়া সংক্রান্ত প্রায় সবক’টি সরকারি পদে তিনি কাজ করেছেন। মিটিং কালচারটা তিনি তাঁর সরকারি দায়িত্বের দিনগুলো থেকে অভ্যস্ত হয়ে থাকতে পারেন।
তোয়াব খানকে গুডমুডে পেলে আমরা নানান প্রশ্ন করে তাঁর জীবনের নানান অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে চাইতাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জেনারেল জিয়া-এরশাদ-বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ সবার সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। সবার ভালোমন্দ তিনি কাছে থেকে দেখেছেন জেনেছেন। মোটকথা তিনি ছিলেন একটি জীবন্ত উইকিপিডিয়া। এনসাইক্লোপিডিয়া! শুধু বাংলাকোষ নয়। বিশ্বকোষও। কারন তিনি পড়তেন বিস্তর। সারাজীবন পড়ার ভিতর ছিলেন।
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকতে এক রমজান মাসের সকালে কোন একটি কাজে জিয়া তাঁকে বাসায় ডেকে নিয়েছেন। ভিতরের রূমে ডেকে নিয়ে বললেন, আসেন আমরা এখানে নাস্তা করতে করতে কাজের কথার আলোচনা করি। কারন বাইরের রূমে সব মুসলমান বসা। তাদের সামনে নাস্তা করা যাবেনা।
রিপোর্টিং-সম্পাদকীয় মিটিং উপলক্ষে প্রতিদিন সকালে অফিসে আসতেন তোয়াব খান। মিটিং শেষে হাতের কাছে থাকা বা বিশেষ বিবেচনায় রাখা রিপোর্ট বা সম্পাদকীয় বিভাগের কপি দেখতেন। অথবা এসব নিজে দেখতে না পারলে বিশেষ অস্বস্তি কাজ করতো তার মধ্যে!
প্রতিদিন সকালে-বিকেলে ক্লিনসেভ কেতাদুরস্ত সেজেগুজে অফিসে আসতেন। তিনি যেহেতু ক্লিনসেভ হয়ে আসতেন আমাদের অনেকেরও অলিখিতভাবে তাঁকে অনুসরনের বাতিক গড়ে উঠেছিল। মিটিঙে আমরা খেয়াল রাখতাম তোয়াব খান কোন একটি ইস্যু নিয়ে কোন লাইনে কথা বলছেন!
রিপোর্ট সে লাইনের হয়ে গেলে বা করা গেলে সে রিপোর্ট হয়তো লিড হতো। একটা পত্রিকায় প্রতিদিন অনেক রিপোর্ট তৈরি হয়। কিন্তু সব রিপোর্ট সেদিন জায়গা করা যায় না বা একসেস অতিরিক্ত হয়। সমসাময়িক রিপোর্ট হলে সেটি লেখার সময় আমাদের চোখে তোয়াব খানের চেহারা ভাসতো!
রিপোর্ট লেখার গাঁথুনি তোয়াব খানের মনমতো হলে সে রিপোর্ট লিড হবে বা গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হবে। সে রিপোর্ট একসেস বা অতিরিক্ত বক্সে চলে যাবেনা। তোয়াব খান বাংলাদেশের মিডিয়ায় অনেক কিছুর জনক। অনেক মেকআপ, অঙ্গসজ্জা তিনি গড়েছেন ভেঙ্গেছেন। তাঁর জায়গায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। বাহ্যত তাঁকে মনে হতো একজন অসন্তুষ্ট মানুষ। তিনি যেন তাঁর কাজে নিজের ওপরই ছিলেন অসন্তুষ্ট! এই অসন্তুষ্টিই ছিল তাঁর চালিকাশক্তি।
প্রতিদিনের মিটিঙের নেতিবাচক দিকও ছিল। যেমন বলা হতো, এ রিপোর্ট আজকেই করতে হবে। আজকেই করতে গিয়ে অনেক রিপোর্ট প্রিম্যাচিউর, অসম্পূর্ন, হাফডানও হয়েছে। সংবাদপত্র অবশ্য দ্রুতগতির সাহিত্য। দ্রুতগতির সাহিত্যের সবকিছু মানসম্মত গভীরতা সম্পন্ন হয়না। এখন যেমন সবকিছু ভাইরাল হয়না। কোনটা ভাইরাল হবে তা আগাম বলা কঠিন।
স্পট রিপোর্ট-সরেজমিন রিপোর্টকে বেশি গুরুত্ব দিতেন তোয়াব খান। সব সময় ভাবতেন তার পত্রিকায় এমন কিছু ছাপা হবে যা অন্য পত্রিকায় নেই। একবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জনকন্ঠের কোন একজন রিপোর্টার সব সময় বিদেশে থাকবেন। এই ধারনা থেকে রেজোয়ানুল হককে আফ্রিকার দেশগুলোতে, আমাকে ফিলিস্তিনের উদ্দেশে মিশর-জর্দানে পাঠানো হয়।
জনকন্ঠের তৎকালীন কূটনৈতিক সংবাদদাতা আমান উদ দৌলাকে হংকং এর ঐতিহাসিক হস্তান্তর অনুষ্ঠানের রিপোর্ট করতেও পাঠানো হয়েছিল। গ্রামীনব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ সম্মেলনেও আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল আমান উদ দৌলাকে। এমন অনেক রিপোর্টার তখন ভ্রমন করেছেন অনেক দেশ। স্পোর্টস রিপোর্টারদের বিদেশ সফর খুব স্বাভাবিক বেশি হতো।
জনকন্ঠের তখন আর্থিক সঙ্গতি ছিল। মালিকপক্ষকেও তোয়াব খান কনভিন্স করতে পারতেন অথবা মালিকপক্ষ তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। তোয়াব খানের নেতৃত্বে বৈচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ জনকন্ঠের পরিচয় হয় প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে। এটা অনেকদিন ছিল।
শাহতা জারাব তখন ছিলেন বাংলাদেশে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত। আমাকে ফিলিস্তিনে নিয়ে যেতে শাহতা জারাব তাদের কায়রো ও আম্মান মিশনকে চিঠি লিখে দেন। কিন্তু তারা আমাকে ফিলিস্তিনে নিতে পারেননি। কারন আমার বাংলাদেশি পাসপোর্ট। ফিলিস্তিন টেরিটোরিতে যাবার ভিসার মালিক ইসরইল।
বাংলাদেশের সাথে যেহেতু ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই তাই আমার ফিলিস্তিন যাবার কোন পথ হচ্ছিল না। অগত্যা কায়রো-আম্মানে থেকেই মিডল ইষ্ট নিউজ এজেন্সি মিনা’র সহায়তা সহ নানা সূ্ত্রে ফিলিস্তিনের রিপোর্ট করতে হয়েছে। তখন অন্য এক তোয়াব খানকে আবিষ্কারের সুযোগ হয়।
১৯৯৭ সালের সেই সময়ে আমাদের হাতে মোবাইল ফোন ওঠেনি। তখনও আমরা হাতে লিখে ফ্যাক্সে রিপোর্ট অফিসে পাঠাই। পত্রিকার তখনও ওয়েবপেজ হয়নি। তাই আমার রিপোর্ট জনকন্ঠে কিভাবে ছাপা হচ্ছে তা দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু তোয়াব ভাইর কারনে এক ধরনের শূন্যতা পূরন হয়।
প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে বা রিপোর্টিং মিটিং শেষে আমার হোটেলে ফোন করতেন। তখন বলতেন রিপোর্টের ভালোমন্দ। আজ এই রিপোর্ট ভালো হয়েছে। কাল এভাবে রিপোর্ট করো। রাতে অফিস থেকে যাবার আগে আবার ফোন করতেন তোয়াব ভাই। এভাবে তোয়াব ভাই’র সঙ্গে মিটিং চলতো ফোনে। বিদেশ বিভূঁইয়ে তাঁর একজন রিপোর্টার এভাবে প্রতিদিন সিক্ত হয়েছেন অপত্য স্নেহে। পহেলা অক্টোবর দেশের একদার সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান তোয়াব খানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর প্রতি অতল শ্রদ্ধা।
(লেখক: ফজলুল বারী, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক, প্রতিষ্ঠাতা-অমর্ত্য ফাউন্ডেশন)