শুক্রবার ২৫ আগষ্ট অমর্ত্যর চলে যাবার দিন। তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। একটি পরিবারের কান্নার তিন বছর। ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারীর বড় ছেলে তৌকর তাহসিন বারী অমর্ত্য ২০২০ সালের ২৫ আগষ্ট মাত্র ২১ বছর বয়সে মারা যান।
বাংলাদেশের অমর্ত্য সেই থেকে সিডনির রুকউড কবরস্থানে চিরশয্যায় শায়িত আছেন। তার সমাধির শিলালিপি বাংলাদেশের পতাকা খচিত। অমর্ত্যর সমাধি সেখানে দ্য সিম্বল অব বাংলাদেশ! সেই ২০২০ সাল থেকে প্রতিদিন দু’বার করে বাংলাদেশ ও সারা পৃথিবীর বাংলাদেশি বাঙালিরা অমর্ত্যর কবর দেখেন।
কারন অমর্ত্যর শোকার্ত পিতা প্রতিদিন সকালে বিকালে দু’বার মৃত সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে যান। কবরের ছবি পোষ্ট করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। গোগল ম্যাপে প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য মানুষ দেখেন অমর্ত্যর কবর! প্রতিদিন এই সংখ্যাটি শুধু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
অমর্ত্যর তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে কুলাউড়ার গ্রামের বাড়িতে কোরানখানি, মিলাদ মাহফিল, দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। কুলাউড়ার প্রয়াত শিক্ষাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত পিটিআই সুপারিন্টেডেন্ট মরহুম মৌলভী জহির আলী ছিলেন অমর্ত্যর দাদা।
ভোলার চরফ্যশন উপজেলার আসলামপুর গ্রামে নির্মিত বায়তুল তৌকির অমর্ত্য জামে মসজিদ, কুলাউড়ার গরিব মানুষদের ফ্রি খাবার ঘর উন্দালে কোরানখানি, মিলাদ মাহফিল, দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। শনিবার দোয়া হবে গাজীপুরের অমর্ত্য ফাউন্ডেশন গরিবের হেঁসেলে।
অমর্ত্যর শোকার্ত পিতা ফজলুল বারী বাংলাদেশের একমাত্র পর্যটক সাংবাদিক। মানুষকে সহায়তার জন্যে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন। অমর্ত্যর হঠাৎ মৃত্যুর পর দিশেহারা পিতা শোক সামাল দিতে গড়ে তুলেছেন অমর্ত্য ফাউন্ডেশন। এর ডোনারদের বেশিরভাগ সাংবাদিক ফজলুল বারীকে ভালোবাসেন।
টাঙ্গাইলের মধুপুরের আদিবাসী নারী বাসন্তী রেমাকে সহায়তার মাধ্যমে অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম শুরু করা হয়। বনবিভাগের লোকজন বাসন্তী রেমার কলাবাগান ধংস করেছিল। অমর্ত্য ফাউন্ডেশন সেখানে গড়ে দিয়েছে আনারসের বাগান। বাসন্তী রেমাকে একটি দোকানও গড়ে দেয়া হয়েছে।
সেই অমর্ত্য ফাউন্ডেশন গত তিন বছরে নানান কর্মকান্ড সম্প্রসারন করেছে। বাংলাদেশে ডাঃ শরফুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে কাজী বাহার, পলি সাহা, হাসিব রহমান, কামরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর, রেজাউল আম্বিয়া রাজু, সাইদুর রহমান চৌধুরী, মাধব ব্রহ্ম, সজিব মন্ডল সহ অনেকে এর সাথে সক্রিয় যুক্ত।
সিডনিতে আবু তারিক, মোহাম্মদ জামান টিটু, আরব আমিরাতে মোহাম্মদ ফরিদ আহমেদ, মেলবোর্নের এসরার ওসমান, নাদিরা সুলতানা নদী, পার্থে শাহজাহান মুন্না, শুভ দাশ, বিলাতে সায়কা চৌধুরী সহ অনেকে এই সংগঠনের নানা কার্যক্রমকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সবখানে।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আসলামপুর গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে বায়তুর তৌকির অমর্ত্য জামে মসজিদ কমপ্লেক্স। মসজিদ কমপ্লেক্সটি এখন দোতলা করার কাজ চলছে। প্রতি শুক্রবার অমর্ত্য মসজিদে শিরনি হয়। মসজিদের মক্তবে প্রতিদিন ৫০ এর বেশি ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে।
বাংলাদেশ ও ভারতে গড়ে তোলা হয়েছে ৫০টির বেশি নলকূপ। ভারতের আসাম রাজ্যের বদরপুর থানার মাছলি গ্রামে দুটি নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। কুলাউড়ার উন্দালে, গাজীপুরের অমর্ত্য ফাউন্ডেশন গরিবের হেঁসেলে অনেক গরিব মানুষের খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে। অনেক দাতা খাবার ঘরগুলোয় অনেক দাতা তাদের স্বজনের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাদের দান পাঠান।
কুলাউড়ার অমর্ত্য পাঠশালা, রংপুরের অমর্ত্য পাঠশালা, বাগেরহাটের চিতলমারীর রুইয়ারকুল গ্রামের অমর্ত্য পাঠশালায় ছাত্রছাত্রীদের ফ্রি পড়ানোর পাশাপাশি খেতেও দেয়া হয়। এসব বাচ্চা গরিব মা-বাবা’র সন্তান। তাদের পোশাক-শিক্ষা উপকরনও অমর্ত্য ফাউন্ডেশন দেয়।
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখার খাসিয়া আদিবাসী, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলের গারো-কোচ আদিবাসী, বান্দরবানের ম্রো আদিবাসীদের ওপর হামলার ঘটনার পর অমর্ত্য ফাউন্ডেশন পাশে দাঁড়িয়েছে। বিপদে সাহস দিতে দ্রুত খাবার সহায়তা পাঠানোর চেষ্টা করা হয়।
করোনা মহামারীর সময় অসহায় মানুষজনকে খাদ্য সহায়তায় নানান চেষ্টা করেছে অমর্ত্য ফাউন্ডেশন। পাঁচশ টাকায় এক পরিবারের এক সপ্তাহের খাবার প্রকল্প বিশেষ কার্যকর হয়। রোজায় ইফতারের পাশাপাশি অভাবী মানুষজনকে সেহেরির খাবার দিয়ে আসছে অমর্ত্য ফাউন্ডেশন দিয়ে আসছে।
ঈদে দেয়া হয় এক ব্যাগ ঈদের খুশি। একটা ব্যাগে শাড়ি-লুঙ্গির পাশাপাশি স্যান্ডেলও দেয়া হয়। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে গত ঈদে সেলোয়ার কামিজও দেয়া হয়েছে ঈদের খুশিতে। শীতে কম্বলের পাশাপাশি দেয়া হয় স্যান্ডেল। এখনও গ্রামের অনেক অভাবী মানুষ খালি পায়ে হাঁটেন। স্যান্ডেল তাদের খুব উপকারে লাগে।
কুরবানির ঈদে চালু করা হয়েছে গরিবের কুরবানির। এই কুরবানির পুরো মাংস গরিবদের মাঝে দান করা হয়। গত কুরবানির ঈদে কুলাউড়া, ভোলা, গাজীপুর ছাড়াও নওগায় এই কুরবানি দেয়া হয়েছে। অমর্ত্য ফাউন্ডেশন অনেক ঘরহীন মানুষকে ঘর বানিয়ে দিয়েছে গত তিন বছরে।
খুলনার একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেয়া হয় মাসিক সম্মানী। কিশোরগঞ্জের শতবর্ষী মা কমলা বেগম, মেধাবী স্কুলছাত্রী অর্পিতা, বাগেরহাটের রামপালের অসহায় মা নমিতা মন্ডলকে আমাদের হয়ে মাসিক টাকা দেন আমাদের তিন দাতা। কমলা বেগমকে ঘর বানিয়ে দেয়া হয়েছে। নমিতা মন্ডলের ঘরও বানানো হবে।
বাগেরহাটের চিতলমারীতে শাপলা তুলে পড়া এক প্রিয় প্রজন্মকে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছে। অমর্ত্য ফাউন্ডেশন তাকেও মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে আসছে। আগামী মাস থেকে এই ভাতা দেবেন নতুন আরেকজন ডোনার। এই পরিবারটির ঘর মেরামত করে দিয়েছেন সিডনির আনন্দ বিজয় রক্ষিত।
সিডনির আনন্দ কুলাউড়ার দুটি প্রতিবন্ধী পরিবারকে মাসে তিন হাজার টাকা করে ভাতা দেন। রংপুরে অমর্ত্যে ফাউন্ডেশনের দেয়া ভাতার টাকার এরমাঝে এক প্রিয় প্রজন্ম অনার্স পাশ করে মাষ্টার্সে পড়ছেন। ঝড়ে তাদের ঘর পড়ে গেলে অমর্ত্য ফাউন্ডেশন সেখানে গড়ে দিয়েছে নতুন ঘর।
সেই প্রিয় প্রজন্মের চাচা দূর্ঘটনায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। অমর্ত্য ফাউন্ডেশন তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করায় সুস্থ হয়ে তিনি আবার কাজে ফিরেছেন। সে গ্রামের এক মেয়ের বিয়ের জন্যে ৪৩ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। রংপুর ও চিতলমারীতে অমর্ত্য পাঠশালার ঘর বানান হয়েছে।
অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের আরেকটি তৃপ্তির প্রকল্প বিয়েতে অর্থ সাহায্য করা। এমন বেশ কয়েকটি পরিবারকে এমন সহায়তা পাঠানোয় পরিবারগুলোর দুশ্চিন্তার অবসান হয়। অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অনেক প্রতিবন্ধী মানুষকে দেয়া হয়েছে হুইল চেয়ার। অনেকে ব্যবসার পুঁজি দেয়া হয়েছে।
এমন সারা বছর ধরেই নানান কার্যক্রমে যুক্ত থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে অমর্ত্য ফাউন্ডেশন। এক্ষেত্রে চ্যারিটি সংস্থাটির অন্যতম একটি শ্লোগান হলো আমরা চাই অমর্ত্যর জন্যে দোয়া ও ভালোবাসা। আমাদের আর কোন দাবি নেই। অমর্ত্যকে রাখুন আপনাদের প্রতিদিনের প্রার্থনায়।