পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক পেরিয়ে সবুজেঘেরা গোমতির বান্দরছড়া গ্রাম। সেখানেই অন্যের কাছ থেকে বন্ধক নেয়া নয় বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন সবজি সাম্রাজ্য। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রতিবন্ধিতা জয় করে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছাপিয়ে তিনি আজ সফল সবজি চাষি। অর্জন করেছেন সফল সবজি চাষির জাতীয় স্বীকৃতিও। বলছিলাম পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়ির গোমতির বান্দরছড়া গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. শফিউল বশরের সবজি বিপ্লবের কথা। নিজের জমি না থাকলেও যে সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করা যায় তার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি।
১৯৯৬ সালে এক প্রতিবেশীর ঘরে লাগা আগুন নেভাতে গিয়ে বাম পায়ে বিষাক্ত কিছু লেগে সংক্রমণ দেখা দেয় শফিউল বশরের। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে ২০০১ সালে বাম পা কেটে ফেলতে হয়। তখন থেকেই ক্র্যাচে ভর করে চলছে তার জীবন-জীবিকা। সম্প্রতি সবজি খেতের ছোট আইলে ক্র্যাচে ভর করে হাঁটতে হাঁটতে এই প্রতিবেদককে নিজের সবজি বিপ্লবের গল্প শোনান শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. শফিউল বশর।
তিনি জানান, শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে গেলেও ভিক্ষাবৃত্তি নয়, নিজের মনের জোরে সাফল্যের স্বপ্ন দেখেছেন। নিজের দশ শতক জমিতে স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এ চিন্তা থেকেই নিজের বাড়ির আশপাশে অন্যের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে সবজি চাষ শুরু করেন ১০-১২ বছর আগে।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বর্তমানে তার বাড়ির চারপাশে অন্যের কাছ থেকে বন্ধক নেয়া নয় বিঘা জমিতেই গড়ে তুলেছেন সবজি খেত। সবজি খেতে আলুর আড়ালে শোভা ছড়াচ্ছে মিষ্টিকুমড়া। তার সবজি জমিতে রয়েছে ক্ষীরা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কাঁচা মরিচ, ভেলু (ডালজাতীয়), করলা ও টমেটো। ডায়মন্ড জাতের আলু গাছের ফাঁকে ফাঁকে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করেছেন ভুট্টা।
শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও ক্র্যাচে ভর করেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির আঙিনায় গড়ে তোলা সবজি সাম্রাজ্য দেখভাল করেন শফিউল বশর নিজেই। তার পরামর্শেই সবজি উৎপাদনে নিরলসভাবে কাজ করছেন ৯-১০ জন নিয়মিত শ্রমিক। বন্ধকি জমিতে সবজি চাষ করে বছরে ৫-৬ লাখ টাকা উপার্জন করেন এ চাষি। শুধু নিজের নয়, তার জমিতে নিয়মিত কাজ করা শ্রমিকদের পরিবারেও আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে।
স্ত্রীসহ দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার শফিউল বশরের। সবজি চাষ করে পরিবারের ব্যয় মিটিয়ে তার দুই ছেলেকে বিএ পাস করিয়েছেন। ছেলেরা শিক্ষিত হয়েও সানন্দে প্রতিবন্ধী বাবার কাজে সহযোগিতা করেন। শ্রমিকের সঙ্গেই কাজ করেন দুই ছেলে। নয় বছর আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন সফল এ মানুষটি।
শারীরিক প্রতিবন্ধী সবজি চাষি মো. শফিউল বশরের বড় ছেলে আবুল বাসার বলেন, ‘লেখাপড়া শেষে চাকরির পেছনে না ছুটে বাবার স্বপ্ন পূরণে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছি। বাবার অদম্য মনোবল আমাদের অনুপ্রাণিত করে।’ খাগড়াছড়ি জেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘একজন প্রতিবন্ধী হয়েও প্রতিবন্ধিতাকে হার মানিয়ে সবজি চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন শফিউল বশর, যা এলাকার মানুষকে উজ্জীবিত করেছে।’
শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও স্বাবলম্বী হতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি উল্লেখ করে মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্ত শেখ মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মো. শফিউল বশর একই জমিতে একাধিক ফসল ফলান। ফলে ফসলে রোগ বালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। পাশাপাশি কৃষকের আর্থিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। প্রতিবন্ধী কৃষক শফিউল বশরের মতো কৃষি নৈপুণ্যে উদ্যোগী হয়ে অনেকে এগিয়ে আসবে বলে মনে করেন তিনি।