
গুলিস্তান বলে কথা! বহুবছর ধরেই রাজধানীর অতিব্যস্ত এলাকা বিজনেস হাব মতিঝিল আর দিলকুশা লাগোয়া গুলিস্তানে গল্পের শেষ নেই। চাঁদাবাজি আর দখলদারিত্ব বছরজুড়েই লেগে থাকে। আছে ছিনতাই, ছুরি চাকুর ভয়। এক সময় লোক ঠকানোর অভিযোগ থাকলেও সাম্প্রতিক সংশোধন হয়েছে ব্যবসার ধরণ। যে কারণে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ মানুষ সখানে বহুমাত্রিক সেবা নিলেও এখন ভয় শুধু সিন্ডিকেটের।
গুলিস্তানে দোকান ভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। ফুটপাত দখলে এসেছে নতুনত্ব। দোকানের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকশ গুণ। পাশেই সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার। তারপরেও অনিয়ম আর দখলদারিত্ব দেখার কেউ নেই। যেকারণে পল্টন, বংশাল, ওয়ারী, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিলসহ আশপাশের থানায় গুলিস্তানের ব্যবসায়ীদের নিয়ে অভিযোগের পাহাড় এখনো প্রতিনিয়ত। কিন্তু কেন?? জানতে চেয়েছিলাম গুলিস্তান পাতাল মার্কেটে মোবাইল বিজনেস করা এক ডজন ব্যবসায়ীরা কাছে। তাদের দাবি, সিটি করপোরেশনে বর্গফুট প্রতি ভাড়[ নির্ধারণ আছে হয়তো ৬০ টাকা। অথচ আমাদের দিতে হয় বর্গফুটে মিনিমাম ৬০০ টাকা। সরকারি হিসেবে ছোট কোন দোকানের ভাড়া যদি হয় ১৮০০০ তাহলে আমাদের দিতে হচ্ছে ৯৮০০০। এর সঙ্গে পানি, গ্যাস, বিদ্যুত, কর্মচারী, যাতায়াত, রাজনৈতিক চাঁদা, খায়খরচা আর যাতায়াত দিয়ে আমাদের পড়ে যায় ১ লাখ ৫০ হাজারের মতো। তাহলে ছোট্ট একটা দোকানের পিছেনে যদি মাসে দেড় লাখ টাকা খরচ দিতে হয় তাহলে আমার সংসার চালাতে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে কতো ইনকাম করতে হবে? মিনিমাম দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। সুতরাং পেটের দায়ে আমাকে ঠক-প্রবঞ্চক কিংবা বাটপার হওয়া লাগবেই। আমি তো বাপের জমি বিক্রি করে দোকান ভাড়া আর কর্মচারীর বেতন দিব না!
প্রায় অভিন্ন কথা বলেছেন ফুটপথের ব্যবসায়ীরা। সরকার পরিবর্তনের ফলে চাঁদাবাজ পরিবর্তন হয়েছে। এখন যারা চাঁদা নিচ্ছে তাদের রেট বেশি। জিজ্ঞাসা করলে বলে, এতোদিন তারা অভুক্ত ছিল। তাই সুদে আসলে এই ১৬ বছরের টাকা এখন দিতে হবে। মাঝ থেকে আমরা ব্যবসায়ীরা আছি বিপাকে। এর বাইরে নেতা, পাতি নেতা, ছুটা চাঁদাবাজ, এই দিবস সেই দিবস, এর জন্মদিন তো ওর মৃত্যু দিবস। এসবের চাঁদা না দিলে অস্ত্রমহড়া। আছে হুমকি কিংবা কিডন্যাপের ভয়। আর এসব কারণে ফুটথের পণ্যেও আগের চেয়ে দাম বেশি নিচ্ছে ব্যবাসয়ীরা। সেখানেও নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট তৈরী করেছে তারা।
এদেরই একজন বিক্রমপুরের শরিফ আমাদের জানালেন, তার মতো সেখানকার সকল ব্যবসায়ীই ভূক্তভোগী। কথা বললেই সমস্যা। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশনের তদারিক দাবি করেছেন তাঁরা। কারণ করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানেন, কোন জায়গায় কত ভাড়া। কোন রাস্তায় বসা যাবে আর কোথায় যাবে না। দেখা যাচ্ছে যে রাস্তায় ব্যবসা করা নিষেধ তা বন্ধ করে দিব্যি ভাড়া দিয়ে খাচ্ছে চাঁদাবাজরা। আগে যেটা যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের লোকজন করতো।
ভোলার চরফ্যাশন থেকে ১১ বছর আগে ঢাকায় এসে গুলিস্তানে ব্যবসা করা রবিউল ইসলাম ওরফে রবি ইঞ্জিনিয়ার বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে ছোট ছোট দোকান। তার সামনে টেবিল চেয়ার দিয়ে এক দুজন করে মোবাইল মেকার বসাই। সেখানেও দোকান মালিকের সমস্যা। ওটা দেখলেই ভাড়া বেড়ে যায় ২০ হাজার। সবমিলে আমরা একটা দোজখখানায় আছি। কাউকে কিছু বলা যাবে না। শুধু খালি চোখে দেখে যেতে হবে। আমাদের এক ব্যবসায়ী প্রতিবাদ করেছিল তাকে একদিনের মধ্যে দোকান থেকে বের করে দিয়েছে। মালামালও নিতে দেয়নি।
মাদারীপুরের ডাশার উপজেলার বাসিন্দা আকাশউজ্জামান বলেন, নতুন একটা চাঁদাবাহ শ্রেণি তৈরী হয়েছে। যারা জুলাই অভ্যুত্থানের নাম করে গুলিস্তানে মাস্তানি করে। আসলে তারা আগে আওয়ামী লীগ বা ফুটপাথলীগের টোকাই ছিল। এখন আবার বিএনপির নাম ভাঙায়। মোট কথা গুলিস্তানের ব্যবসায় একটা অরাজকতা চলছে। যে যার যেভাবে পারে সেভাবেই লুটে খাচ্ছে।
এতোকিছুর পরও গুলিস্তান পাতাল মার্কেটের আবার সুনামও আছে। একটা মোবাইল ঠিক করতে বসুন্ধরা, ইস্টার্ণ প্লাজা কিংবা মোতালেব প্লাজায় গেলে যে টাকা নিবে তার চেয়ে অনেক কমে এখানে হয়-দাবি পাতাল মার্কেটের আই ফোন বিশেষজ্ঞ সাগর রায়ের। পাশাপাশি সেবাগ্রহীতার অভিযোগের ব্যাপারটিও স্বীকার করেন তিনি।
ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বলছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীনে তৈরি হাওয়া মার্কেটটি সরকার সাত লক্ষ টাকায় লিজ দেয়। এটি দেশের সর্ববৃহৎ মোবাইল মার্কেট হওয়ায় এই মার্কেটে সারা বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষ আসতো। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দোকান মালিকরা সিটি কর্পোরেশনের নিয়মের বাইরে কয়েকগুণ ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা এডভান্স এবং ৯০ থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া প্রতিমাসে পড়ে যায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, সীমিত সংখ্যক দোকান হওয়ায় মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন দোকান মালিকদের কাছে।
আহম্মদ হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, এটা সত্যি যে অতিরিক্ত মুনাফার কারণে প্রায়ই সেবা গ্রহীতার সঙ্গে মোবাইল মেকারদের বচসা হচ্ছে। এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ১ লাখ টাকা দোকান ভাড়া ছাড়াও কর্মচারী বেতন, কারেন্ট বিল, এসি বিল ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে মাসিক খরচ ২ লাখের মতো। এই বাড়তি আয় করতে গিয়ে অদি পুরোণো, দুই নম্বর পার্টস লাগিয়ে দেয়। সেটি অল্প দিনে নষ্ট হলে গেলেই মারমুখি ভাব নিয়ে সেবা গহিতারা ছুটে আসে। তখন একটা গ্যাঞ্জাম কিংবা মারামারির মতো কিছু একটা ঘটে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সূত্র বলছে, তাদের হিসেবে এসব দোকানের ভাড়া ১৮ থেকে ২০ হাজার। কিন্তু করপোরেশনকে না জানিয়ে দোকানিরা ইচ্ছেমতো লাখ টাকা আদায় করছে। দোকানিরা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে অপরাধমূলক ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে হলে দোকানের ভাড়া লাখ টাকা কমিয়ে সিটি করপোরেশন নির্ধারিত ১৮ থেকে ২০ হাজারে ফিরতে হবে। করপোরেশন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলে ভাড়া কমে যাবে তখন আমরাও কম টাকায় সেবা দিতে পারব। পাতাল মার্কেট সূত্র বলছে, রাজনৈতিক দল ও দোকান মালিকরা মিলে দোকানগুলো পরিচালনা করে থাকে।