
বয়স তখন ১২। ছায়ানটে নাচ শিখতে যাই। সঙ্গে আমার বোন। মা সঙ্গে করে নিয়ে যান মাঝেমধ্যেই। শান্ত স্নিগ্ধ সে পরিবেশ প্রথম দিনেই আমাকে আপন করে নেয়। মেরুন রঙের ছায়ানট ভবনের এ পাশ ওপাশ দেখি। আর খুঁজে ফিরি একজনকে-তিনি আর কেউ নন সনজীদা খাতুন। যাঁর কথা বহুবার শুনেছি বহুজনে। ভর্তির অল্পদিনেই তাঁর দেখা পাই। বুকের মধ্যে দুরুদুরু। এতো বড় মাপের মানুষ, এতো এতো সুনাম। পৃথিবীজুড়ে থাকা অসংখ্যা বাঙালি যাঁর গুণগ্রাহী। সেই মানুষটিকে সামনে পেলে কিভাবে কোন ভাষায় সম্বোধন করবো।
হঠাৎই তাঁর সাক্ষাতে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। রূপালি চুল। মায়াবি মুখখানা গোলগাল-ভরাট। চোখে পাওয়ার গ্লাস। দিদিমাসুলভ শাড়িতে শুধু মায়া আর মায়া। কপাল ভর্তি মায়ের মতো বিশাল একখানা টিপ। লালের সে আভা ছড়িয়ে পড়েছে ছায়ানটের পশ্চিম দেয়ালে। দেখেই মনে হলো মমতায় বিশাল, শিক্ষায় ছাড় না দেয়ার মতো বজ্রকঠিন ব্যস্ত মানুষ। তাঁর চলায় স্থিতধি ভাব। চুপচাপ অতিশয় ভদ্র। সবই যেনো শেখার মতো।
আমি হাত জোড় করে প্রণাম জানাই। ঘাড় নেড়ে তার উত্তর ও সম্মতি জানান বিদুষী। বুকের ভেতর দিয়ে বরফের স্রোত নামে। মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে গেলাম। নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছিল। হ্যাঁ ইনিই সেই কাঙ্খিত মহিয়সী।
আমরা যারা নাচ শিখতে গিয়েছিলাম তাদের সাথে ওনার দেখা হওয়ার খুব একটা সুযোগ ছিল না। তাঁর তুলনায় আমরা ছিলাম নার্সারি ক্লাস স্টুডেন্টের মতো। পরে জেনেছি-গান তাঁর জীবিকা নয়।গান গাওয়া ও শেখানো তাঁর জীবন।মানুষজনের সঙ্গে মিশে যাওয়া এক জীবন। শুদ্ধ সংগীত চর্চাই ছিল সনজীদা খাতুনের প্রাণ। আমাদের বাঙালি আত্মপরিচয় খুঁজে দিতেন তিনি।
এই মানুষটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় সক্রিয় ছিলেন ভাষা আন্দোলনে। ক্রমশ তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধায় পরিণত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সনজীদা খাতুন তাই হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাসের কালরাত্রির দিনেই পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। অর্থাৎ ২৫ মার্চ ঐতিহাসিক ক্ষণে। যে মানুষটি দেশের আত্মপরিচয় খুঁজেছেন রবীন্দ্রনাথের গানে, সেই গানের মধ্য দিয়েই তিনি বিদায় নিয়েছেন ইহজীবন থেকে।
ছায়ানটের ক্লাস থেকেই জেনেছি, স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল রবীন্দ্র সঙ্গীত।সেই ক্রান্তিলগ্নে বাঁধ ভেঙেছিলেন সনজীদা খাতুন আর তাঁর সহযোদ্ধারা। শত বাধার মুখে রবীন্দ্র-শতবর্ষ উদযাপন, দেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ছায়ানট প্রতিষ্ঠা, ঢাকায় রমনা বটমূলে বর্ষবরণসহ তাবৎ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনকে ঋদ্ধ করেছেন তিনি। আমি গর্বিত যে, আমি তাঁর রক্তঘামে গড়া প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের শিক্ষার্থী। যে প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে ছায়া হয়ে আছেন সনজীদা খাতুন।
জয়তু সনজীদা খাতুন- বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আকাশে আজীবন নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করবে আপনার মাহাত্ম।