শুক্রবার,

৩১ জানুয়ারি ২০২৫

|

মাঘ ১৭ ১৪৩১

XFilesBd

শিরোনাম

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু শনিবার উজানের দেশগুলোর কাছে বন্যা পূর্বাভাসের তথ্য চাওয়া হবে : পানি সম্পদ উপদেষ্টা নোয়াখালীতে পানি কমছে, ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টে রিট দেশের ১২ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে অপসারণ শেখ হাসিনা মেনন ইনুসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হত্যাকান্ড, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিচার হবে নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও করে না : প্রধানমন্ত্রী সাবেক আইজিপি বেনজীরের সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ আদালতের হবিগঞ্জের কার ও ট্রাকের সংঘর্ষে নারীসহ নিহত ৫ যুদ্ধ ব্যয়ের অর্থ জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবহার হলে বিশ্ব রক্ষা পেত: প্রধানমন্ত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী প্রাণি ও মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর বিএনপি নেতারা সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দেওয়ার অপচেষ্টা করছে : ওবায়দুল

প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের ঘরের চাবি

তপোব্রত ঘোষ

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৩:২৮, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের ঘরের চাবি

ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ গানটিকে নিয়ে এই ধন্দ প্রাচীন যে, কেন এখানে রবীন্দ্রনাথ ‘চাবি’ লিখেছেন! এখানে তো ‘তালা’ হওয়ার কথা! ‘যাবি’-র সঙ্গে মিল লাগানোর খাতিরেই ‘তালা’ না লিখে রবীন্দ্রনাথ ‘চাবি’ লিখেছেন—একথা ভাবতেও সংকোচ হয়; তাই অগত্যা ‘কবিগণ নিরঙ্কুশ’ বচন স্মরণ করে এবং poetic licence –এর দোহাই মেনে চুপ করে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

কিন্ত এ কি সত্যিই poetic licence? অভিধানের সমর্থন কি নেহাতই অলভ্য? এই কৌতূহলাক্রান্ত আমি মান্য বাংলা অভিধানগুলিতে খুঁজতে শুরু করে শেষপর্যন্ত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ দেখলাম--কী দেখলাম তা এই পোস্টের শেষে সংযোজিত প্রথম পৃষ্ঠা-প্রতিচ্ছবিতে দেখুন : 'চাবি' শব্দের অর্থ ‘তালা’-ও হয়!

যোগেশচন্দ্রের এই অভিধান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২০-২২ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ মোটামুটিভাবে ১৯১৩-১৫ খ্রিস্টাব্দে; আর ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ লেখা হয় ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ২৪ আশ্বিন, অর্থাৎ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর; এর মানে হল, রবীন্দ্রনাথ যখন এই গানে তালা ভাঙা অর্থে চাবি ভাঙা প্রয়োগ করলেন তখন এই প্রয়োগে অভিধানের সমর্থন ছিল! অর্থাৎ এ আদৌ poetic licence নয়।

রবীন্দ্র-জীবনের শেষ দশকের কবিভাষাতেও এই প্রয়োগ দেখা যায়। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘সানাই’ কবিতাবইয়ের ‘অদেয়’ কবিতায় বন্দিনী মেয়েটি তার প্রিয়কে বলছে—

কে দেয় দুয়ার রুধে,
একলা ঘরের স্তব্ধ কোণে থাকি নয়ন মুদে।
কী সংশয়ে কেন তুমি এলে কাঙাল বেশে।
সময় হলে রাজার মতো এসে
জানিয়ে কেন দাওনি আমায় প্রবল তোমার দাবি।
ভেঙে যদি ফেলতে ঘরের চাবি
ধুলার ’পরে মাথা আমার দিতেম লুটায়ে,
গর্ব আমার অর্ঘ্য হত পায়ে।

এখানেও লক্ষ করুন, বাইরে-থেকে-দুয়ার-রুদ্ধ-করা ঘরে বন্দিনী মেয়েটি সেই  ঘরের তালা ভেঙে তাকে উদ্ধার করার কথা তার প্রিয়কে বলছে না; সে বলছে, ‘ভেঙে যদি ফেলতে ঘরের চাবি’ !

এখন, ‘চাবি’ শব্দের একটি অর্থ যদি ‘তালা’ হয়, তাহলে—বলা বাহুল্য—‘তালা’ শব্দের একটি অর্থ হবে ‘চাবি’। এই পোস্টের শেষে সংযোজিত দ্বিতীয় পৃষ্ঠা-প্রতিচ্ছবি দেখুন। একটি কবিতা থেকে ঔৎসুক্যজনক উদাহরণ দেওয়া যাক। বাইরে-থেকে-ঘর-বন্ধ-করার ব্যাপার এই কবিতায় দ্বিরুক্ত হয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথ অনায়াসে একবার 'চাবি' আর একবার 'তালা' লিখেছেন : অর্থাৎ এই দুটি শব্দ এক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে বিনিময়যোগ্য হয়ে উঠেছে! ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'শিশু ভোলানাথ' কবিতাবইয়ের 'বাউল' কবিতায় দূরের অশথতলায় দাঁড়ানো বাউলকে শিশু ভোলানাথ অনুরোধ করেছে যে, ওই বাউল যেন দূর থেকে কাছে এসে সামনের আঙিনায় তার একতারাটিতে সুর লাগিয়ে নাচে--ওই নাচে যোগ দেবার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই বলে অন্তত দেখেও সে আনন্দ পেতে চায়। কেন উপায় নেই?--

পথে করতে খেলা
আমার কখন হল বেলা
আমায় শাস্তি দিল তাই।
ইচ্ছে হোথায় নাবি
কিন্তু ঘরে আমার চাবি
আমার বেরোতে পথ নাই।

পাছে দুরন্ত শিশু ভোলানাথ বেরিয়ে যায়, তাই অভিভাবকরা তার 'ঘরে চাবি' দিয়েছেন। নিজের এই ঘরবন্দি অবস্থার সঙ্গে তুলনা করে শিশু ভোলানাথ এই একই কবিতায় বাউলের উদ্দেশে বলেছে--

সমস্ত দিন কাটে
তোমার পথে ঘাটে মাঠে
তোমার ঘরেতে নেই তালা।

অর্থাৎ বাউলের বাড়ির লোকরা কেউ বাউলকে ঘরবন্দি করেননি--'তোমার ঘরেতে নেই তালা'--আর তাই তো বাউল সমস্ত দিন ঘরের বাইরে--পথে ঘাটে মাঠে--কাটিয়ে দিতে পারছে! একই কবিতায় বাইরে-থেকে-ঘর-বন্ধ-করার প্রথম উল্লেখে 'চাবি', আর দ্বিতীয় উল্লেখে 'তালা'-র প্রয়োগ লক্ষ করুন।

এবার আসছি ভিতর-থেকে-ঘর-বন্ধ-করার প্রসঙ্গে।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত রবীন্দ্রনাথের একটি গানের প্রথমার্ধ এই সূত্রে লক্ষণীয়—

তুমি বাহির থেকে দিলে বিষম তাড়া
তাই ভয়ে ঘোরায় দিকবিদিকে,
শেষে অন্তরে পাই সাড়া।
যখন হারাই বন্ধ ঘরের তালা—
যখন অন্ধ নয়ন, শ্রবণ কালা,
তখন অন্ধকারে লুকিয়ে দ্বারে
শিকলে দাও নাড়া। 

এখানে ‘আমি’ বন্ধ ঘরের মধ্যে রয়েছি, যে-ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ‘তুমি’ আমাকে বেরিয়ে আসবার জন্য বিষম তাড়া লাগিয়ে বন্ধ ঘরের কপাটের বহির্ভাগে ঝোলানো শিকলে নাড়া দিচ্ছ। আমি বেরোতে পারছি না, কারণ আমার এই বন্ধ ঘরের ‘তালা’ অর্থাৎ চাবিটা (বিবেচনা করে দেখুন যে, তালা তখনই হারাতে পারে যখন তালাটা লাগানোই হয়নি; আর সেক্ষেত্রে বন্ধ ঘর সহজেই খোলা যায় এবং বাইরে থেকে তাড়া দেওয়ারও কোনো কারণ থাকে না!) আমি হারিয়ে ফেলেছি; এবং তোমার তাড়া লাগানোয় ভয় পেয়ে ঘরের মধ্যেই দিকবিদিকে চাবির খোঁজে ঘুরছি, কিন্ত যেহেতু আমার নয়ন অন্ধ, তাই ঘোরাও সার হচ্ছে; অবশ্য আমার শ্রবণ কালা হওয়া সত্ত্বেও-যে তোমার শিকল নাড়ার আওয়াজটা আমার কানে পৌঁছোল—এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, তোমার অধৈর্য কত জোরে ওই শিকলটাকে নাড়াচ্ছিল।

বুঝতেই পারছেন, ভিতর থেকে ঘর বন্ধ করে কেউ দরজায় চাবি দিয়ে চাবিটা ঘরের মধ্যেই হারিয়ে ফেলতে পারে; কিন্তু কেউ কি ঘর ভিতর থেকে বন্ধ করে দরজায় তালা লাগায়? তা যে লাগায় না--এর প্রমাণস্বরূপ এ গানের রচনাকালের অনেক আগে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘স্বর্ণমৃগ’ গল্পের এই পংক্তিটি উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘আহারান্তে ঘরে ঢুকিয়া [বৈদ্যনাথ] দ্বারে চাবি লাগাইয়া দিলেন।’ এখানে 'চাবি' নেহাত চাবিই, কিছুতেই তালা নয়।

তাহলে দেখা গেল, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ গানে ‘চাবি’-র অর্থ যেমন তালা, তেমনি ‘তুমি বাহির থেকে দিলে বিষম তাড়া’ গানের ‘যখন হারাই বন্ধ ঘরের তালা’ পংক্তির ‘তালা’ –র অর্থ চাবি।