গত এক সপ্তাহ ধরেই একটা স্বপ্ন ঘোরের মধ্যে কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনালের শিক্ষার্থীরা। তারা নাটক করবে! তাও আবার শিল্পকলা একাডেমিতে। যেখানে ইয়া বড় শিল্পী আর কলাকুশলীরা মঞ্চ কাঁপান। সুতরাং রিহার্সালের ফাঁক গলে এক আধটু টেনশন যে হয়নি তা নয়। তবে সব দু:শ্চিন্তার প্রয়াণ ঘটলো পবিত্র সেই মাহেন্দ্রক্ষণে। একে একে মঞ্চে উঠলেন খুদে শিল্পীবৃন্দ। ভিনি-ভিডি-ভিসি প্রবাদের মতোই আসলেন, দেখলেন, জয় করলেন। মুহূর্তেই খুদে অভিনেতাগণ জায়গা করে নিলেন আগত দর্শকদের মণিকোঠায়।
ধানমন্ডির ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনালের শিক্ষার্থীরা টানা ৪০ মিনিট ধরে আওড়ে যান নাটকের সংলাপ। কারও মুখে কোন কথা আটকায়নি। ঘটনার আবর্তে নিজের মতো করে কেউ কেউ সংলাপ বলার চেষ্টা করেছে। যেটি ছিল আরও সুন্দর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতা অবলম্বনে নাটকটি মঞ্চস্থ করেন ছাত্রছাত্রীরা। অনবদ্য নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন কার্ডিফের নৃত্য ও নাট্যকলার শিক্ষক পারিসা আফরোজ। মায়ের চরিত্রে ইন্দ্রাক্ষী দাস মজুমদার ও বীরপুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেছে যথাক্রমে আয়েশা নুসরাত, রাফিদ ইউনুস ও হাফসা। নেপথ্যে থেকে পুরো আনুষ্ঠানিকতায় যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি আর কেউ নন-কার্ডিফ স্কুলের প্রিন্সিপাল আয়েশা শারমিন চৌধুরী।
নাটকটির অন্যান্য চরিত্রে রয়েছে আয়েশা নুসরাত, শাইস্তা ওয়াহুজ শিরোপা, মাহরিন যারা, মাহীরা আরিয়া, ইনায়া, মানহা, ওয়াসি, ফাবিয়ান, তাজবীর, ফাইয়াদ, সারিনা, আরিবা, ফাতেমা নামিরা, সুমাইজা, আরিশা, আলায়না, সাবা, ইরা, যারা, সারা মির্জা, ফারহান, আয়ান, আহনাফ, মাহরিন, কেয়ান, রাইয়ান, সামিন, অগ্নিস্নান পোদ্দার, সারিনা, আরুশা, ইজানা, রুহি, রাকিব প্রমুখ।
ছোট্ট ছেলে-বেশ কল্পনাবিলাসী। কারও কাছে সে মাথা নোয়াতে রাজি নয়। অকুতোভয় সেই বীর মাকে ভীষণ ভালোবাসে। মায়ের বিপদে তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করতে। খোকা কল্পনা করে বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছে অনেক দূরে...। ‘বীরপুরুষ’ নাটকে এমন কিছু দৃশ্যই নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলে কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকার শিক্ষার্থীরা। যেখানে একজন শিশুর ভয় জয় করে সাহসিকতার উদাহরণ স্থাপনের গল্প প্রণিধানযোগ্য। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মঞ্চে রোববার সন্ধ্যায় প্রথমবারের মতো বার্ষিক নাট্য প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতেই ছিল এসএম রায়হানুল আলমের কোরিওগ্রাফিতে নৃত্য আলেখ্য-‘আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে’।
নাট্য প্রদর্শনী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন খ্যাতিমান অভিনেতা ও পরিচালক এবং প্রাচ্যনাটের প্রতিষ্ঠাতা আজাদ আবুল কালাম। স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘শিল্পকলার মঞ্চ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও পেশাদারি মঞ্চ। এখানে আমিও অভিনয় করি এবং টেনশন ফিল করি। যখন দেখি কেজি অথবা নার্সারি পড়ুয়া কেউ অভিনয় করছে-তখন আমার কাছে বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হয়। কারণ সে তো আমার সঙ্গে ফাইট করছে! এ কথা বলেই তুমুল হাসিতে ভরপুর করে তোলেন অডিটরিয়াম। করতালিতে তাঁকে স্বাগত জানান অন্য অতিথিরা। কার্ডিফ স্কুলের প্রথম প্রযোজনা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘বীরপুরুষ’ নির্বাচন করায় আয়োজকদের ধন্যবাদও জানান তিনি।
আজাদ আবুল কালাম বলেন, এটি ভালো সিদ্ধান্ত। আমরা দেখেছি শিশুরা বইয়ের বোঝার মধ্যে বড় হতে থাকে। বইকেন্দ্রিক যে শিক্ষা তা বড় বিষয় নয়। আসলে শিক্ষা হচ্ছে তার চারপাশের জগৎ। দুনিয়াটা যে বিরাট একটা বই তা অনেকেই ভুলে যায়। সেই বইয়ের একটা অংশ হচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতি। শিশুদের শেকড়ের সঙ্গে কানেকশন জরুরি।’
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হালফিল অবস্থা বর্ননা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। পাশাপাশি এও বলেন, চারপাশে যখন শিক্ষায় এক ধরণের অন্ধকার আভা বিদ্যমান সেখানে কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল অনেক আলোর ঝলকানি দেখালো। যা অন্য প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুকরণীয় বটে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জেএমআই গ্রপের এমডি আব্দুর রাজ্জাক, কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চেয়ারম্যান সুরাইয়া আকতার রীনা, দৈনিক সমকালের উপসম্পাদক মাহবুব আজীজ, সিটি ব্যাংকের মিডিয়া ম্যানেজার আলপনা আখতার, প্রাচ্যনাটের অভিনেতা ও নাট্যপরিচালক তৌফিকুল ইমন। কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনালের প্রিন্সিপাল আয়শা শারমিন চৌধুরী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি শিক্ষক আসাদুজ্জামান ও ইভানা হক।
জেএমআই কর্ণধার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘সারাক্ষণ শুধু পড়া আর পড়া। বলতে গেলে বইয়ের ভেতরে শিশুরা ডুবে থাকে। এটি ঠিক নয়। পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুদের এক্সট্রা কারিকুলামের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। শিশুদের মেধার বিকাশ ঘটাতে নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন জরুরি, যা শুরু করেছে কার্ডিফ স্কুল। বক্তব্য দিতে গিয়ে মিস্টার রাজ্জাক ছোটবেলার অনেক স্মৃতি রোমন্থন করেন। যেখানে শিশুর মানসিক বিকাশের নানান বিষয়াদী সাবলীলভাবে উঠে আসে। ’
নাটকটি শিশুদের আত্মবিশ্বাসের জায়গায় ইতিবাচক পদক্ষেপ-এমন কথা বলেন সমকালের উপসম্পাদক মাহবুব আজীজ। তাঁর অভিমত, আমাদের বড় অবলম্বন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ, প্রতিরোধ এবং নিস্পাপ হৃদয়– এই তিনের যে মেলবন্ধন আমরা দেখলাম, তা সবার মধ্যে অনেক বেশি মানবিকবোধ উদ্ভাসিত করে। ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতাটি আমরা ছোটবেলা অনেকেই পড়েছি। নাটক মাত্রই তো মঞ্চে দাঁড়িয়ে শুধু কথা বলা নয়। এটি আমাদের শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিক্রমায় অনবদ্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। এটি শিশুদের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। মানুষের সামনে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শেখাবে। মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি প্রতিরোধের শক্তি। নাটকে প্রতিবাদের যে উপস্থাপন দেখলাম, আগামীতে তা শুধু কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনালের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই প্রতিফলিত হবে না অপরাপর শিক্ষার্থীদেরকেও বোধসম্পন্ন করবে। অনুষ্ঠান শেষে অভিনেতা অভিনেত্রীদের হাতে সনদ তুলে দেন অতিথিবৃন্দ।