“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ ফজিলাতুন নেছা ছিলেন একে অপরের পরিপুরক এবং তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল স্বর্গীয় কমনীয়তার মতো। এক কথায় আমরা বলতে পারি, তাঁদের জন্মই হয়েছিল একে অপরের জন্য”- একথা উল্লেখ করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গমাতা সব সময় অনুঘটকের ভুৃমিকা পালন করেছেন।
বঙ্গমাতার ৯৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাসসের সাথে আলাপকালে ড. আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বঙ্গমাতা শৈশবকালেই পিতা-মাতা হারিয়ে বঙ্গবন্ধুন বাবা- মায়ের কাছে বড় হয়েছেন। তাই শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা দুজনে একই পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। তিনি বলেন,‘ সুতরাং তাদের উভয়ের মধ্যে শৈশব থেকে যে মানসিকতার মিল তৈরি হয়েছিল, তা তাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অটুট ছিল।’ অধ্যাপক সিদ্দিক বলেন, ‘১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপরই বঙ্গমাতাকে হত্যা করা হয়। তাঁরা এক সাথে থাকতেন এবং আমরা বলতে পারি- এ দু’জন একে অপরের জন্য জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং একসাথে শাহাদাত বরণ করেছেন। মনে হয়, বেগম মুজিব যেন বঙ্গবন্ধুর সাথে সহ-মরনই বরন করেছিলেন।’ বঙ্গমাতা কিভাবে তাঁর পাশে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’তে তার উল্লেখ আছে। তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু ছাত্র থাকা অবস্থায়ই বঙ্গমাতা স্বামীর জন্য কিছু অর্থ সঞ্চয় করতেন এবং বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকা বা কোলকাতা থেকে গোপালগঞ্জ আসতেন, তখন ঐ সামান্য পরিমান অর্থই বঙ্গমাতা তাঁর হাতে তুলে দিতেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ধুমপান করতেন, যা তিনি নিজের স্মৃতিচারণেই উল্লেখ করেছেন, ‘আমার কেবলমাত্র একটা খারাপ অভ্যাস আছে ধুমপান এবং যে কারণে আমার অহেতুক কিছু অর্থ ব্যয় হয়।’
এমনকি বঙ্গবন্ধুর ধুমপানের জন্য অতিরিক্ত অর্থ যোগাতে বঙ্গমাতা সঞ্চয় করেছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বঙ্গবন্ধুর তিনটি বইয়ের খসড়া প্রণয়নে বঙ্গমাতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বদা অমূল্য সম্পদ হিসেবে ইতিহাস হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা বলছি। তাঁর বক্তৃতা ও বক্তব্য বিভিন্নভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর নিজের স্মৃতিকে নিজের ভাষায় প্রকাশ করা একটি বিরল ঘটনা এবং এটি বঙ্গমাতার কারণেই সম্ভব হয়েছে।’ বঙ্গমাতা বই লেখার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রাণিত ও অনুরোধ করেছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গমাতা পদক্ষেপ না নিলে এত মূল্যবান বই নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হতো না এবং জাতির ইতিহাসের পাশাপাশি এই মহান নেতার সমসাময়িক রাজনৈতিক সম্পর্কে জানানোও সম্ভব হতো না। অধ্যাপক আরেফিন বলেন, 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের স্মৃতিচারণে আরও উল্লেখ করেছেন যে কীভাবে বঙ্গমাতা তাঁকে বই লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গমাতা প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়িত বীরাঙ্গনাদের (যুদ্ধের বীরাঙ্গনা) পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বেগম মুজিবের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে প্রথমবারের মতো নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন শুরু হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি কিভাবে সরকারকে সহযোগিতা এবং নারীদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করা যায়, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট নারীকে জড়ো করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় বৈঠক করেন।
বঙ্গমাতার সহনশীলতা ও ধৈর্যের উদাহরণ টেনে অধ্যাপক আরেফিন বলেন, ১৯৪৬ সালে কলকাতার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় বঙ্গবন্ধু কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রনেতা ছিলেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দাঙ্গা নিরসনে কাজ করছিলেন। কিন্তু বেগম মুজিব তখন একজন সন্তান সম্ভবা এবং অসুস্থ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু বঙ্গমাতা তখন বঙ্গবন্ধুর কাছে এই মর্মে চিঠি লিখে পাঠালেন যে “আপনার উপর এখন বিরাট দায়িত্ব ন্যস্ত। সমাজ আপনাকে চায়। সমাজ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। এখন আপনার হাতে অনেক কাজ। আমাকে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আমার ব্যাপারগুলো সামলে নিতে পারবো।”
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে চিঠি লেখেন, ‘এখন তোমার বড় দায়িত্ব। তোমাকে সমাজের প্রয়োজন .. . সমাজ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। এখন সমাজের জন্য কাজ করতে হবে। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। আমি আমার বিষয়গুলো সামলাতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এরপর সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন যে ‘আপনি একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে আপনার জীবনে উপহার দিয়েছেন।’ এরপর তিনি ’উল্লেখ করেন,‘অন্য একজন রাজনীতিকের স্ত্রী সম্পর্কে একজন রাজনীতিকের এই মন্তব্য থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি, বেগম মুজিব কতটা সহনশীল ও ধৈর্যশীল ছিলেন এবং মানুষের জন্য তার হৃদয়ে কতটা ভালোবাসা ছিল। তিনি তার স্বামীর পাশে থাকার প্রয়োজনের সময়ও তাকে সবসময় সমাজের জন্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি বলেন, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে গোলটেবিল আলোচনার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গমাতা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, বঙ্গমাতার সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে নি:শর্ত মুক্ত দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে পাকিস্তানী শাসকদের বাধ্য করেছিল এবং এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপথও বদলে দিয়েছে।