হিন্দু সংস্কৃতিতে মূর্তির ইতিহাস বেশ প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। শুধু ভারতেই নয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে ভিন্ন দেবতার মূর্তি। সর্বোচ্চ উঁচু কয়েকটি মূর্তির মধ্যে প্রথম দিকেই আছে বাতু কেভস। ছবিতে দেখা যায় বিশাল পাহাড়। পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকৃতির, প্রায় পাহাড়সম এক সোনালি রঙের মূর্তি। মূর্তির পাশ দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি পথ। শত শত সিঁড়ি পথের শেষ মাথায় গুহামুখ। বাতু কেভসের এই ছবিটিই সবচেয়ে কমন। ছবিতে মূর্তির পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া সিঁড়ি পথের শেষে যে গুহামুখ, সেই গুহামুখের রহস্যময়তাই সবাইকে সেখানে টেনে নিয়ে যায়।
সোনালি রঙের ১৪০ ফুট উঁচু মুরুগান মূর্তি চুনাপাথরে তৈরি। এ পাহাড়ে ‘ভেল’ আকৃতির গুহামুখ দেখে আকৃষ্ট হয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ী থাম্বুসামী পিল্লাই মুরুগান দেবতাকে উত্সর্গ করে ১৮৯২ সালে মূর্তিটি তৈরি করেন। ভেল হচ্ছে মুরুগানের হাতের অস্ত্রসদৃশ দণ্ড। চব্বিশ মিলিয়ন রুপি খরচ করে কংক্রিট ও স্টিলবারে নির্মিত এই মূর্তিটি সোনালি রং করার জন্য স্বর্ণ থেকে তৈরি তিনশ’ লিটার স্বর্ণালি রং থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল। বাতু কেভস মূলত হিন্দুদের (তামিল ভাষাভাষি) ধর্মীয় তীর্থস্থান।
বাতু কেভসের সীমানায় ঢোকার পর যা দেখা যাবে, তার অধিকাংশই বিশাল আকৃতির। বিশাল আকাশ ছোঁয়া পাহাড়। তা-ও মাটির পাহাড় নয়, কঠিন পাথরের পাহাড়। মূল গেটের বাম দিক দিয়ে ঢুকলেই পড়বে বিশাল হনুমান দেবতার মূর্তি। একটি মন্দির পার হলেই মূল মূর্তি, মুরুগানে মূর্তি। তারপর দুইশ’ বাহাত্তর ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে গেলেই বিশাল গুহা।
যদিও মুসলমান মেয়েরা প্রায় সবাই মাথায় স্কার্ফ পরে কিন্তু চাইনিজ, জাপানিজ, থাই, ফিলিপিনো মেয়েদের প্রায় সবাইকে শর্টস পরতেই দেখা যায়। অন্যদিকে তামিলদের অধিকাংশ মেয়েকেই দেখা যায় জর্জেটের ওড়নার মতো হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটা কাপড় কোমর থেকে প্যাঁচ দিয়ে পরে আছে। এখানে এসে চাইনিজ, জাপানিজ মেয়েদের স্টাইল হঠাৎ করেই বদলে যায়। কারণ সেখানে সাইন বোর্ডে লেখা আছে, এটি একটি ধর্মীয় উপাসনালয়। শর্টস পরিধান করে প্রবেশ নিষেধ। তার পাশেই তামিল মেয়েরা টেবিল পেতে বসে আছে। টেবিলের ওপর জর্জেটের ওড়না। এখান থেকে ওড়না কিনে শর্টস ঢাকলেই তবে ওপরে ওঠা যাবে। অধিকাংশই গুহা দেখার আকর্ষণে শর্টস ঢেকে ওড়না পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যতিক্রমও দেখেছি। যদিও অনেকেই দেখলাম, বেশ কিছুক্ষণ তর্ক করে বোঝাতে চেষ্টা করল এটা যুক্তিহীন।
২৭২টি সিঁড়ি পার হয়ে উপরে উঠলে মূলগুহা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বানরের দল এসে ঘিরে ধরবে। ছোট ছোট বাচ্চা বানর থেকে শুরু করে বুড়ো বানর পর্যন্ত। এরা সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার সময় মানুষের ওপর দিয়েই ঝাপাঝাপি করে। খাবার দেখলে নিতে চায়। আমি যখন উঠছিলাম- তখন দেখলাম, এক নারীর হাতের পলিব্যাগে ফাস্ট ফুড ছিল। এক বানর এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। তামিলরা সাধারণত খুব সাহসী হয়, কিন্তু তিনি বানরের আকস্মিক আক্রমণে ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। বানররা শুধু খাবার দেখলেই হামলা করে ব্যপারটা তা নয়। মধ্যপ্রাচ্যের এক মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল। হঠাৎ এক বাচ্চা বানর এসে কোনো কারণ ছাড়াই তাকে খামচি মেরে চলে গেল। সে উপরে উঠে ভয়ে কাঁপছিল।
সে দোকানদারদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল বানরের খামচিতে কিছু হবে কিনা। দোকানদাররা সম্ভবত না জেনেই উত্তর দিলো, কিছু হবে না। যদি এরা কোনো জলাতঙ্কবাহী প্রাণির কামড় খেয়ে থাকে তাহলে বিপদ হতে পারে।’ মেয়েটি ফ্যাকাশে মুখে বলল, এখন আমি কী করব?একজন বললো ভীত হওয়ার কিছু নেই। আপনি শহরে ফিরে গিয়েই ভ্যাকসিন নিয়ে নিবেন।
বাইরে থেকে পাহাড়টা যত বিশাল মনে হয়, ভেতরে গুহা তত বড় নয়। ইনকাদের মতো পুরো একটা কমিউনিটি বাস করতে পারবে। এখন বাস করছে তামিল ধর্মযাজকরা। পুরো এলাকাতেই তামিলদের আধিপত্য। গুহার মধ্যে যেতে হলে ভিতরে আবার সিঁড়ি ভেঙে নিচের দিকে নামতে হয়। চারদিকে দেব-দেবীর ছোট ছোট মূর্তি রহস্যময়ভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছে। গুহার ভেতর থেকে উপরের দিকে তাকালে ছোট ফোঁকর দিয়ে আকাশ দেখা যায়। বিপরীত দিকে আরেকটি মুখ আছে। সেখান দিয়ে বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। বনের মতো ঘন গাছপালা।
ধর্মীয় কারণে বাতু কেভসে সবসময় মানুষের পদচারণা। না হলে এই গুহাটি রয়ে যেত রহস্যঘেরা। যার রহস্যে মানুষ রোমাঞ্চিত হতো এবং না দেখার অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে, ফেরত আসতে হতো নিজ গন্তব্যে। যদিও স্থানটি হিন্দু ধর্মের উপাসনালয় হলেও, সোনালী রঙের এই মূর্তি ও পাহাড়ের গুহামুখের রহস্যময়তাই সবাইকে সেখানে টেনে নিয়ে যায়।