পোলান্ডের পোজনান শহর বেশ ক’বছর ধরেই বাংলাদেশী ছাত্রদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। এলাকার গ্রোসারি থেকে শুরু করে পরিচিত ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলা ভাষা বেশ পরিচিত। এমনকি অনেক ইটালিয়ান কিংবা জার্মান নাগরিকও শখের বশে বাংলা শিখতে শুরু করেছে। হঠাৎ করেই সেই শহরে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। কারণ আর কিছুই না-তথাকথিত ভাইয়া গ্রুপের উৎপাত।
পোজনান পলিটেকনিক, পোজনান ইউনিভার্সিটি অফ লাইফ সায়েন্স, পোজনান ইউনিভার্সিটি অফ ইকোনমিক্স বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখা করে বাংলাদেশের কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী। এখান থেকে পড়ালেখা শেষ করে অনেকেই পোল্যান্ডের বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছে। এদের বড় অংশ পোজনান শহরে বিভিন্ন পেশায় ঢুকে পড়ায় সেখানে বাঙালিদের সুনাম ছড়াতে শুরু করেছে। প্রাক্তন ছাত্র কিংবা এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই হওয়ার সুবাদে নতুন ছাত্র ছাত্রীরা উনাদের সাথে একটা সখ্যতা গড়ে তোলেন সাহায্য সহযোগিতা পাবার আশায়। কিন্তু কিছু সংখ্যক কথিত বড়ভাই এই সম্পর্কটাকে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির কাজে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। যাদের আচরণে বিদেশে দেশের সুনাম নষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
কারণ কথিত ঐ সব বড়ভাই নির্ধারণ করে দিচ্ছে কে কার সঙ্গে মিশবে। কে কার মেসে থাকবে। কোন ছাত্র কার সঙ্গে বাসা ভাড়া নিবে-এসব। এমনকি তাদের আয়োজন করা খেলাধুলাতেও কে অংশ নেবে কি নেবে না তাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে বড় ভাইয়ের গং। তাদের নির্দেশ না মানলে র্যাগ দেয়া হচ্ছে কখনও গোপনে কখনও সবার সামনে। অকারণে অপমান করে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকিও দেয়া হচ্ছে। ব্যাপারটি ইতোমধ্যে পোলান্ডের পুলিশের কানেও পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ দূতাবাসও খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে।
এসব বড় ভাইয়েরা আবার নিজেদের দলে টানতে সেমি বড়ভাই নিয়োগ দিচ্ছে। তারাই মূলত বাছাই করছে কাদেরকে র্যাগ দেয়া হবে, কাকে অপমান অপদস্থ করা হবে এসব। এদের গ্রুপে বেশিরভাগই প্রাক্তন ছাত্র রয়েছে। পোলান্ডের বাঙালি কমিউনিটির অভিযোগের ভিত্তিতে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেলো, এই কথিত বড়ভাইদের গডফাদার হচ্ছে প্রাক্তন ছাত্র রাহাত কবির। সঙ্গে রয়েছে জাফর ইকবার নামের এক ব্যবসায়ী। তার প্রতিষ্ঠানে বসেই সব ধরণের সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়। এদের সেমি নেতা হচ্ছে সাজ্জাদ কবির, নাহিন মাহমুদ মিমো, ওমর বিন রহমান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মাহমুদুল হাসান, শাহাদত মনির। এরা সবাই প্রাক্তন ছাত্র। দুজন ব্যবসা শুরু করেছে সম্প্রতি।
কদিন আগে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তানভীর ইসলাম রিজভী নামের এক ছাত্রকে রাহাত কবীর ঈদের দিনে নিজের বাসায় দাওয়াতের কথা বলে নিয়ে যায়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে আগে থেকেই ২০-২৫ জনের একটি গ্ৰুপ তৈরী ছিল। সেখানে তানভীর কার কাছে কি মন্তব্য করেছে তা নিয়ে প্রথমে শুরু করে মানসিক অত্যাচার,। পরে হাত পা বেঁধে মারধর করে। এই ঘটনায় তানভীর এতটাই হতভম্ব হয়ে পরে যে, সেখানে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরে কয়েকজন মিলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষনিক পুলিশ কল করে। খবর দেয়া হয় স্থানীয় দূতাবাসে। হামলার ব্যাপারটি জানাজানি হলে বাঙালি কমিউনিটির ক্ষতি হতে পারে বলে তানভীর ঘটনাটি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুরো ঘটনা জেনে যায়। অতপর ঐসব কথিত বড় ভাই থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে তানভীরকে নজরে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল বডি।
উল্লেখ্য, পোজনান হচ্ছে বাংলাদেশিদের জন্য অত্যন্ত সম্ভনাময় একটি শহর। পড়ালেখা শেষ করে অনেকেই সেখানে ভাল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। সবমিলে বাঙালিদের ঘিরে পোজনানে একটি সুন্দর বলয় তৈরী হয়েছে। তাই প্রতি বছরই এই শহরে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। কিন্তু এই কথিত বড় ভাইদের দৌরাত্ম বেড়ে যাওয়ায় নতুন আসা শিক্ষার্থীদের মা বাবা ও তারা নিজেরাও বেশ উদ্বেগে আছে। তাদের অভিযোগ, এসব ভাইয়া গ্রুপকে এখনই যদি প্রতিহত না করা যায় এবং র্যাগিং বন্ধ না হয় তাহলে বাঙালি ছাত্রছোত্রীদের ভবিষ্যত অন্ধকার। এমনকি বড় ধরণের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। এই বড় ভাইয়ের কেউ কেউ আবার পোজনান শহরে ক্লাব ও জুয়ার নেশায় জড়িয়ে পড়ায় মহাআতঙ্কে নতুন আসা শিক্ষার্থীরা।